আবু সাইদ বিশ্বাস শ্যামনগর থেকে ফিরে: জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলা করে মনোরম পরিবেশে স্থাপত্য শৈলী এবং নান্দনিকতার ছুঁয়াই নির্মিত সাতক্ষীরার ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে দিনের পর দিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে তোলা এই কমিউনিটি হাসপাতাল সাতক্ষীরার হাজার হাজার মানুষের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। উপকূলের এমন একটি এলাকায় এ হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়েছে যেখানে প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে অসংখ্য প্রাণহাণী ঘটে। হাসপাতালটির চারিপাশে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা কৃত্রিম খাল। এসব খালের দুই পাশে গড়ে তোলা হয়েছে ভবন। আর এসব খালে ধরে রাখা হয় বৃষ্টির পানি। এ খালে পানির কারণে গ্রীষ্মের সময় ভবন ও এর আশপাশের এলাকা ঠান্ডা থাকছে। এ ছাড়া হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিভাগকেও আলাদা করা হয়েছে নকশা করা এ খাল দিয়ে। গড়ে তুলতে হয়নি কোনো দেয়াল। এদিকে, উপকূলীয় দূর্যোগ প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা সাতক্ষীরার মানুষের কাছে চিকিৎসা সেবায় আশীর্বাদ হয়ে এসেছে শ্যামনগনের এই ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। উপজেলা সদরের কাছে সোয়ালিয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালে পাওয়া যাচ্ছে সরকারি মেডিকেল কলেজের সমান স্বাস্থ্যসেবা।
২০১৩ সালে এই হাসপাতালের নির্মাণকাজ শুরু হয় । আর নির্মাণকাজ শেষে হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু ২০১৮ সালের ২২ জুলাই। শ্যামনগর উপজেলার সোয়ালিয়া গ্রামে ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ একর জমির ওপর আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত এ হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। এ স্থাপনা ২০টি ভবনের সমন্বয়ে ৪৭ হাজার ৭৭২ বর্গফুট জায়গাজুড়ে কিস্তৃত।
পানিকে গুরুত্ব দিয়ে গড়ে তোলা এ স্থাপনা জিতেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টসের (রিবা) ২০২১ সালের বিশ্বসেরা নতুন ভবনের পুরস্কার। রিবার ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে, দুই বছর পরপর এ পুরস্কার দেওয়া হয়। বিশ্বজুড়ে উদাহরণ সৃষ্টিকারী ও সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, এমন স্থাপনাকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ‘আরবানা’র পরিচালক কাশেফ মাহবুব চৌধুরী বলেন, সব সময় পানির সঠিক ব্যবহার হয় না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এর অর্থ হলো, এ এলাকায় যে শস্যখেত রয়েছে, তা তলিয়ে যাচ্ছে এবং চিংড়ির ঘেরে পরিণত হচ্ছে। এ ছাড়া ভূপৃষ্ঠে যে পানি রয়েছে, তা আরও লবণাক্ত হচ্ছে। সাতক্ষীরা অঞ্চলে বর্ষার সময় মানুষ বৃষ্টির পানি ধরে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকেন। তাই কাশেফ মাহবুব চৌধুরী এমনভাবে ভবনটির নকশা করেছেন, যাতে বৃষ্টির পানি এতে ধরে রাখা সম্ভব হয়। এ হাসপাতালের আঙিনা, ভবনের ছাদ থেকে পানি যাতে এক খালে যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর কৃত্রিম এ খাল গিয়ে ঠেকেছে জলাধারে।
হাসপাতালের পরিবেশ প্রসঙ্গে কাশেফ বলেন, ‘যখন কেউ অসুস্থ হয় বা কারও যতেœর প্রয়োজন হয়, তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলোর মধ্যে একটি হলো তার মানসিক অবস্থা। আমি মনে করি, চিকিৎ্সার সময় আপনি যে ধরনের জায়গায় বাস করেন, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালের জলাশয়, গাছ, পাখির শব্দ, আলো, বাতাস আরোগ্যলাভের ক্ষেত্রে গতি আনে।’
সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, হাসপাতালটি তৈরি করেছে এনজিও ফ্রেন্ডশিপ। এর আগে বলা হয়েছিল, রিবার যে জুরিবোর্ড এ পুরস্কার প্রদানে কাজ করে থাকে, সেই জুরিবোর্ডের প্রধান ওডিলে ডেক। তিনি বলেন, বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে এ প্রকল্প প্রাসঙ্গিক। দ্য গার্ডিয়ান এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইট দিয়ে এ হাসপাতাল ভবন তৈরি করা হয়েছে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য জ্বালানির সাহায্য নিতে হবে না, এমন ভাবনা মাথায় রেখে ৮০ শয্যার এ হাসপাতালের নকশা করা হয়েছে। আর এ কারণেই জার্মানির বার্লিনের জেমস সিমন গ্যালারি ও ডেনমার্কের লিলে ল্যাঞ্জেব্রো সেতুকে পেছনে ফেলে রিবা পুরস্কার জিতল এ হাসপাতাল।
গত ১৬ নভেম্বর রিবা আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ‘বিশ্বের সেরা নতুন ভবনের’ সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেখানে বাংলাদেশের সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের সঙ্গে ছিল জার্মানির বার্লিনের জেমস-সায়মন-গ্যালারি এবং ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের লিলে ল্যাঞ্জেব্রো সেতু। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা দক্ষিণ বাংলা পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে সাতক্ষীরার ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। স্থাপনাটিকে একটি ‘মানবিক স্থাপত্য’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ স্থাপনার বিশেষত্ব হচ্ছে, স্থানীয় প্রকৌশলীরা স্থানীয়ভাবে তৈরি নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে ভবনটি গড়েছেন। ভবনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে প্রচুর আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে। নিশ্চিত করা হয়েছে বিদ্যুতের সর্বনিম্ন ব্যবহার।
ফ্রেন্ডশিপের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক রুনা খান বলেন, “গত ২০ বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি তারা এ পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারে না। ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল তাদের জন্য একটি উন্নততর আগামীর আশা দেখিয়েছে।”
৬ জন চিকিৎসক, ১২জন নার্স এবং অন্যান্য সহকারীর সমন্বয়ে ৮০ শয্যার হাসপাতালটিতে রয়েছে ৪টি ওয়ার্ড। ৩টি অপারেশন থিয়েটারের মাধ্যমে বেশিরভাগ অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে এখানে। প্রতিদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগ খোলা থাকে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। দন্ত, চোখের ছানি, জরায়ু ক্যান্সার, হৃদরোগ, তালুকাটা, বার্ন, ফিজিওথেরাপি, স্ত্রীরোগ এবং শিশুরোগ নিয়ে বছরে ১২ থেকে ১৫টি বিশেষ ক্যাম্প পরিচালিত হয় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের উদ্যোগে। শুধু হাসপাতাল কমপ্লেক্স নয়, শ্যামনগরের বিভিন্ন ইউনিয়নে শিক্ষার্থী ও গৃহবধূদের নিয়ে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন ক্যাম্পেইন।
বিশ্বের ১১টি দেশের ১৬টি ব্যতিক্রমী নতুন স্থাপনা থেকে বাছাই করে তিনটি স্থাপনার সংক্ষিপ্ত তালিকা চূড়ান্ত করে রিবা আন্তর্জাতিক পুরস্কারের পাঁচ সদস্যের জুরি বোর্ড। সেখান থেকেই দ্বিবার্ষিক এ পুরস্কারের চূড়ান্ত বিজয়ী হিসেবে সাতক্ষীরার ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের নাম উঠে আসে পুরুষ্কারের তালিকায়।
Check Also
সাতক্ষীরায় লটারীতে টিকে থাকা ৭১ শিক্ষার্থীকে ভর্তির সুযোগের দাবিতে অভিভাবকদের সংবাদ সম্মেলন
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি ভর্তির লটারীতে টিকে থাকার পরও শুধুমাত্র বয়সের অজুহাতে সাতক্ষীরা সরকারি বালক ও বালিকা …