স্টাফ রিপোটার: সাতক্ষীরা পৌর মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতি ক্ষমতার অপব্যবহার, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও পৌরসভার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার বিরুদ্ধে ১১ জন কাউন্সিলরের আনা অভিযোগ মিথ্যা প্রমানে ব্যর্থ হয়ে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছে। মঙ্গলবার পৌরসভার কাউন্সিলরদের পক্ষ থেকে প্যানেল মেয়র কাজী ফিরোজ আহমেদ এ কথা বলেন। তিনি বলেন, গত ১৩ জানুয়ারি-২০২২ কাউন্সিলরদের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করা হয়। সেই অভিযোগের তদন্ত চলছে। সেই অভিযোগ ধামাচাপা দিতে সবধরণের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে এখন কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন।
গত ছয় বছরে পৌরসভার বিভিন্ন খাত থেকে ৩২ কোটি ৯২ লাখ ৫ হাজার ৭৯৯ টাকার অনিয়ম, দুর্র্নীতি, আত্মসাত ও বিধিবহির্ভূত ব্যয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে কাউন্সিলরদের পক্ষ থেকে।
প্যানেল মেয়র কাজী ফিরোজ আহমেদ আরো বলেন, মেয়র তাজকিন আহম্মেদ চিশতি সাংবাদিকদের কাছে ১ ও ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে মিনি মার্কেটে দোকান বরাদ্দের বিষয়। এই দোকান বরাদ্দ হয় ১৯৭৬ সালে। কাউন্সিলর সৈয়দ মাহামুদ পাপার বাড়ি মার্কেট সংলগ্ন হওয়ায় তিনি বিধি মোতাবেক দোকান ঘর বরাদ্দ নেন এবং এর বহুদিন পরে তিনি কাউন্সিলর হন। এছাড়া কাউন্সিলর কামারুজ্জামান হিমেল গত নির্বাচনে কাউন্সিলর হয়েছেন। তার বাবা বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ আশরাফুজ্জামান আশু ও তাঁর স্ত্রী ১৫-১৬ বছর পূর্বে দুটি দোকান ঘর বরাদ্দ নিয়ে ব্যবসা করছেন। এখন তাঁদের বিরুদ্ধে এ ধরণের অভিযোগ আনা রীতিমত হাস্যকর।
প্যানেল মেয়র কাজী ফিরোজ আহমেদসহ ১১ জন কাউন্সিলর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছেন সেগুলোর কথা উল্লেখ করে বলেন, প্রত্যেকটি অভিযোগের স্বপক্ষে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমান রয়েছে এবং তদন্তে তা প্রমান হবে। একারণে মেয়র চিশতি ভুল বকতে শুরু করেছে।
এদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে গত ১৩ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে কাউন্সিলরদের পক্ষ থেকে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, পৌর আইন উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ একক ক্ষমতায় মেয়র চিশতি তার কর্মকালে ৭৬ লাখ ৫৬ হাজার ৯০২ টাকা পানির বিল মওকুফ করে পৌরসভার আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছেন। কিন্তু পৌরসভার বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে সাড়ে ৫ কোটি টাকা। এছাড়া পৌর পানি সরবরাহ শাখার কর্মচারীদের দু’মাসের বেতন বকেয়া আছে। তার এরূপ কর্মকান্ড স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) আইন ২০১০ এর ৩১(১) (খ) (ঘ) এর সুস্পষ্ট লংঘন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, বর্তমান মেয়র অবৈধ সিন্ডিকেট করে তার দলীয় পছন্দের ব্যক্তিদের নিকট হাট-বাজার ইজারা প্রদান করেছেন। তাদের নিকট থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে কোন ইজারা গ্রহীতার সাথে চুক্তিপত্র সম্পাদন করেননি। হাট-বাজার ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুসারে দরপত্র দাতা অবহিত হওয়ার ৭ কার্যদিবসের মধ্যে সমুদয় অর্থ প্রদানের বিধান আছে। কিন্তু মেয়র সম্পূর্ণ বিধি-নিষেধ পরিপন্থীভাবে হাট-বাজার ইজারা গ্রহীতা গণের নিকট প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ ৯৫ হাজার ৯৭১ টাকা বকেয়া রেখেছেন। এটা সম্পূর্ণভাবে আইনের বরখেলাপ।
অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, সাতক্ষীরা পৌরসভার মোট ৯টি পাবলিক টয়লেট আছে। মেয়র তাজকিন আহমেদ দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে কোন পাবলিক টয়লেট ইজারা দেননি। এমনকি খাস কালেকসনের মাধ্যমে উপার্জিত একটি টাকাও পৌর কোষাগারে জমা প্রদান করেননি। এছাড়া পৌরসভার মোট ১৬.৬১২ টি খানা বিদ্যমান। প্রতিটি খানা থেকে প্রতি মাসে ৫০, ৮০ ও ১০০ টাকা করে সংগ্রহ করা হয়। উক্ত হিসাব মতে বিগত ৫ বছর মেয়র ও কনজারভেপি সুপারভাইভার এর সাথে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে ১৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকা আত্মসাত করেছেন। বিগত ৩ বছরের কোন টাকা জমা প্রদান না করে আত্মসাৎ করেছেন মেয়র মো: তাজকিন আহমেদ।
অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, পৌরসভা কর আরোপ ও আদায় পদ্ধতি বিধিমালা অনুসারে পৌর কর সরকারি দাবি। স্থায়ী কমিটির সুপারিশে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়া তা বেশি সরকারি দাবি মওকুফের কোন বিধান নেই। কিন্তুু মেয়র চিশতি ৬ বছরে স্থায়ী কমিটির সুপারিশ ছাড়াই একক ক্ষমতাবলে ৪০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হারে ১ কোটি ৩৩ লাখ ৩ হাজার ২২১ টাকা মওকুফ করেছেন। এছাড়া একক ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিগত ৬টি অর্থবছর ১০ কোটি ২ হাজার ৬৯৬ টাকা লাইসেন্স ফি মওকুফ করেছেন।
ভ্রমন ও আপ্যায়ন বিল প্রসঙ্গে কাউন্সিলররা তাদের অভিযোগে উল্লেখ করেছেন, মেয়রগণের আপ্যায়ন সীমা সম্পর্কে কোন আইনগত বিধান না থাকলেও সকল ক্ষেত্রে প্রচলিত বিধান অনুসারে চাকরি (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০১৫ অনুসরণ করা হয়ে থাকে। উক্ত আইনের ২৫ নং ধারা অনুসারে যুগ্মসচিব/অন্যান্য প্রাধিকারভুক্ত কর্মচারীগণ ৬০০ টাকা আপ্যায়ন ভাতাপ্রাপ্ত হওয়ার বিধান আছে। কিন্তু মেয়র তাজকিন আহমেদ বিগত ৬ বছর ২২ লাখ ৪৪ হাজার ৬২২ টাকা ভূয়া আপ্যায়ন বিল করে পৌর ফান্ড থেকে টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়াও তিনি বিগত ছয় বছর ভূয়া ভ্রমন বিল দেখিয়ে পৌরসভা ফান্ড থেকে ১০ লাখ ৫৩ হাজার ৪১০ টাকা উত্তোলন করেছেন।
বাজেট ছাড়া টেন্ডার সম্পর্কে কাউন্সিলররা বলেন, মেয়র নির্বাচনের পূর্বে জনগণের সাথে প্রতরণা ও অনৈতিক আর্থিক সুবিধা গ্রহণের নিমিত্তে ২০২০-২১ অর্থবছর ৯৮ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা এডিপি বরাদ্দের বিপরীতে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৭২ হাজার টাকার ৯টি স্কিমে টেন্ডার প্রদান করেন। তিনি নিজে গ্রহণ এবং দলীয় কর্মীদেরকে আর্থিক সুবিধা প্রদানের জন্য টেন্ডার ছাড়াই পৌরসভার কাজে ডিপিএম পদ্ধতিতে ক্রয়কার্য করেন। এক্ষেত্রে টেন্ডার ছাড়া বছরে তাঁর সর্বোচ্চ ক্রয় ক্ষমতা ১০ লাখ টাকা। কিন্তু তিনি বিধি লংঘন করে ২০১৬-১৭ অর্থ বছর ২৭ লাখ ৪৫ হাজার ৫৪৮ টাকা, ২০১৭ ১৮ অর্থ বছর ৬৩ লাখ ৬১ হাজার ১৪৯ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থ বছর ৫৭ লাখ ৬৭ হাজার ২৩৩ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থ বছর ৬০ লাখ ১৮২ টাকা, ২০২০-২১ অর্থ বছর ৭৯ লাখ ৩৬ হাজার ৮৭৩ টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থ বছর ১৪ লাখ ২২ হাজার ৭২৭ টাকার ক্রয় করেছেন। মূলত তিনি সম্পূর্র্ণ বিধি নিষেধ অমান্য করে আর্থিক সুবিধা গ্রহণের জন্য ভূয়া বিল ভাউচার করে পৌরসভার টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
দলীয় কর্মীদের আর্থিক সাহায্য প্রদান প্রসঙ্গে অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, মেয়র তাজকিন আহমেদ কোন প্রকার কারণ ছাড়া নিজ দলীয় কর্মীদের মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্য করে থাকেন। মূলত তিনি পৌরসভা ফান্ডকে নিজ দলীয় কর্মীদের প্রতিপালনের তহবিলে পরিণত করেছেন। তিনি বিগত ৬ বছর পৌরসভা ফান্ড থেকে ১ কোটি ৮ লাখ ৮৯ হাজার ৭৪৮ টাকা আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছেন।
অভিযোগে স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) আইন, ২০১০ এর ১৯ এর (২) (ছ) নং ধারা অনুসারে পৌরসভা মেয়র বা কাউন্সিলর কর্তৃক পৌরসভার কোন ঠিকাদারী কাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু মেয়র তাজকিন আহমেদ পৌরসভা থেকে ঠিকাদারির জন্য ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করেছেন। তার ঠিকাদারি লাইসেন্স নং-০৮-০০০-১০৩৩০। তিনি সারসরি পৌরসভা কর্তৃক বাস্তবায়িত “জলবায়ু সহিষ্ণু অবকাঠামো প্রতিষ্ঠানিকীনে প্রকল্প” সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। তার পরিচালিত সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক এর সাতক্ষীরা শাখা থেকে মেসার্স তাজকিন আহমেদ নামীয় হিসাব থেকে পেঅডার জমা নেওয়া হয়েছে।
অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, মাষ্টার রোলের মাধ্যমে নিয়োগকৃত কর্মচারীদের নিজ হোটেল, ঠিকাদারি ও পরিবহন ব্যবসায় ব্যবহার করেছেন।
এছাড়া মেয়র তাজকিন আহমেদ ক্ষমতা অপব্যবহার করে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে পৌরসভার কাজ দেখিয়ে বিভিন্ন চেকের মাধ্যমে ৪২ লাখ ৬৯ হাজার ৫০৭ টাকা উত্তোলন করেন। পৌরসভার তহবিল হতে তিনি ব্যক্তিগত সিআরবি-১৫-৬৬৭৭ নং গাড়ি ও পালসার মোটার সাইকেলের জন্য ৩ হাজার ৬৩৯ লিটার অকটেন গ্রহণ দেখিয়ে প্রায় ৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা তছরুপ করেছেন। সরকারি অতি জরুরি কারন এবং সরকারি নির্দেশনা ছাড়া বিমানযোগে ঢাকায় ভ্রমন দেখিয়ে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে পৌর মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতি জানান এস অভিযোগ মিথ্যা ভিত্তিহীন ও গুজব। তার সূনাম নষ্ট করতে একটি মহল চক্রান্ত করছে।