মাতৃভাষায় কথা বলা যেমন মানুষের জন্মগত অধিকার তেমনি ভাষার মান-মর্যাদা রক্ষা করাও প্রত্যের নাগরিকের কর্তব্য। মায়ের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রেখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। বর্তমানে বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাঙালিরা এবং অন্যান্য জাতির মানুষ বাংলা ভাষার জ্ঞান অর্জন করছেন। যেখানে ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষরাই বাংলার চর্চায় পিছিয়ে নেই, সেখানে বাঙালি হয়ে নিজ ভাষার চর্চায় পিছিয়ে থাকাটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে বুকে লালন করা প্রত্যেক বাঙালির কর্তব্য। কারণ, যেদিন থেকে আমরা মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার পেয়েছি, সেদিন থেকেই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি।
সময়ের পরিক্রমায় আমাদের মানসিকতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গিছে যে, আমরা বাংলা অপেক্ষা পাশ্চাত্য বা অন্য ভাষায় কথা বলতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। বাঙালীর অসংখ্য ত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় আমরা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি। আজকাল কিছু পরিবার তাদের সন্তানদের ইংরেজি চর্চায় এতোটা গুরুত্ব দেন, যার ফলে বাচ্চারা ঠিকভাবে বাংলায় কথা বলতে বা লিখতে তেমন সক্ষম হয় না যতোটা ইংরেজিতে হয়। যে শিশু তার নিজ ভাষার ব্যবহারই শিখতে পারেনি, তার পক্ষে ভাষা আন্দোলনের চেতনা বুকে লালন করা নিতান্তই আশাতীত।
পৃথিবীর বুকে বাঙালি একমাত্র জাতি যাদের নিজ ভাষার অধিকার অর্জনে সংগ্রাম করতে হয়েছে। মাতৃভাষার মুক্ত চর্চার জন্য করতে হয়েছে দীর্ঘ আন্দোলন, বিসর্জন দিতে হয়েছে অসংখ্য প্রাণ। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারের মতো বীরদের রক্তক্ষয়ী ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজ বাধাহীনভাবে ভাব বিনিময় করতে পারি আমাদের প্রণের বাংলা ভাষায়। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম কি কঠোর ত্যাগের বিনিময় পাওয়া এই ভাষাকে সকলের সম্মুখে নির্ভুলতার সঙ্গে উপস্থাপনের মাধ্যমে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে সক্ষম হচ্ছে? এ প্রশ্নটি করা অনেকের নিকট নিতান্তই অজ্ঞতার পরিচায়ক হলেও মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্বটি অবহেলার আড়ালেই রয়ে গেছে বৈকি!
বাংলা বাঙালি ভাষা, চিরকালই তাই ছিল, এখনো সেরকমই আছে; কিন্তু শাসকরা জনগণের থেকে দূরেই রয়ে গেছে, যেমন তারা আগে ছিল। শাসক শ্রেণির সন্তানরা ইংরেজি শেখে, তারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে, বিদেশে ঘরবাড়ি কেনে এবং তাদের সন্তানরা বিদেশমুখো হয়। বাংলার প্রচলনের অন্তরায় অন্য কেউ ঘটাচ্ছে না, জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে দেশের বিদেশমুখো ও বিদেশপ্রভাবিত শাসকরাই ঘটাচ্ছে। শাসক শ্রেণির ভেতর রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলা, পেশাজীবী সবাই আছে। তাদের প্রধান যোগ্যতা তারা ধনী। এরা ইংরেজি ব্যবহার করতে পারলে খুশি হয়। পাশাপাশি বানিজ্যিক রেডিও স্টেশনগুলোর বিকৃত ও বাংলিশ উচ্চারণ মাতৃভাষাকে প্রভাবিত করছে।
ভারতীয় টেলিভিশন ও ইউটিউবের মাধ্যমে বর্তমানে আমাদের দেশের ঘরে ঘরে ও হাতে হাতে আগমন ঘটছে হিন্দি ভাষার। যার কারণে অনেকেই অতি সহজে বাংলাকে বিতাড়িত করে হিন্দি ভাষা শিখছে। অতীতে আমরা উর্দুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু বর্তমানে হিন্দির জন্য আমাদের দরজা-জানালা খোলা। বিশ্বে এখন বাংলাভাষীর সংখ্যা প্রচুর, ত্রিশ কোটিরও বেশি হবে; সংখ্যাবিচারে বাংলাভাষী মানুষের স্থান পঞ্চম। কিন্তু বাংলা ভাষার মর্যাদা খুবই কম। কারণ কী? কারণ হচ্ছে আমরা সংখ্যায় অনেক ঠিকই কিন্তু সক্ষমতায় সামান্য। অনেকটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মতোই; পরিমাণে শিক্ষিতদের সংখ্যা অনেক, কিন্তু গুণগতমান নিম্নগামী।
কেবল বাংলাদেশে নয়- বিশ্বজুড়ে যে বাঙালিরা রয়েছে তাদের ভাষা অবশ্যই নিজের জন্য মর্যাদার স্থান খুঁজে নেবে। কিন্তু দায়িত্বটা বাংলাদেশের মানুষেরই, নেতৃত্ব তাদেরই দিতে হবে। বাংলাভাষার উৎকর্ষ ও প্রয়োগ বৃদ্ধির জন্য আমরা বিভিন্ন কাজের সুপারিশ করতে পারি। যেমন, পাঠাগার গড়ে তোলা; বাংলায় সংস্কৃতিচর্চার গুণ ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি। বলতে পারি ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণের আবশ্যকতার কথা। সাহিত্যচর্চার অপরিহার্যতার বিষয় তুলে ধরতে পারি। উচ্চ আদালতের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের অনুরোধ জানাতে পারি বাংলা ব্যবহারের। কিন্তু মূল ব্যাধিটাকে যেন না ভুলি। সেটা হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্র। ওই চরিত্রে বদল ঘটিয়ে, রাষ্ট্রকে জনগণের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। সেটা ঘটলে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের সর্বত্র জনগণের ভাষা অব্যাহতরূপে ব্যবহৃত হবে, তার উন্নতির পথে অন্তরায় থাকবে না।
মায়ের ভাষা বাংলা ভাষার মর্যাদা আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। দেশের সর্বত্রই বাংলা ভাষার প্রচলনের ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সন্তানদের বাংলা ভাষা শেখার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে হবে।
বিলাল হোসেন মাহিনী
পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ও প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, যশোর।