যারা বিএনপি থেকে জামাতকে আলাদা করতে চাই তারা আওয়ামীগকে ক্ষমতায় ধরে রাখতে চাই

২২ বছর আগে বিএনপির নেতৃত্বে যে চারটি দলের সমন্বয়ে জোটবদ্ধ রাজনীতির শুরু হয়েছিল—তা এখন সমাপ্তির পথে। জাতীয় পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট এবং সর্বশেষ খেলাফত মজলিসের প্রস্থানের মধ্য দিয়ে চারদলীয় জোটের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রায় সব শরিকই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দলটির সঙ্গত্যাগ করলো। বাকি রইলো কেবল জামায়াতে ইসলামী। যদিও বিএনপির সঙ্গে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী এ দলটির সম্পর্কের ব্যাপারটি নানা অংকে আটকে রয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও দলটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীলদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির আনুষ্ঠানিক জোট সম্পর্ক ধরে রাখতে খোদ বিএনপিতে কয়েকটি শক্তিশালী পক্ষ রয়েছে। একটি পক্ষ দলের নেতাদের মধ্যে সক্রিয়। দলের চেয়ারপারসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত একটি পক্ষ। বিএনপিপন্থী লেখক, বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ এবং ২০ দলীয় জোটের একটি অংশের নেতারা কোনওভাবেই জামায়াতকে বিএনপির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন দেখতে আগ্রহী নয়। দায়িত্বশীলদের দাবি, যখনই জামায়াতকে ছাড়ার বিষয়ে আলোচনা আসে, তখনই এই পক্ষগুলো একসঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে। একদিকে জামায়াতও চায় না বিএনপিকে ত্যাগ করতে, অন্যদিকে দলের ভেতরে-বাইরে তাদের অনুসারীদের শক্ত বলয়।

দায়িত্বশীলরা জানাচ্ছেন, সুশীলদের মধ্যে যারা জামায়াত ত্যাগে অনীহা দেখায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে তারা যুক্তি দেখায়—জামায়াতকে ছেড়ে দিলে বিএনপি আরও চাপে পড়বে। একইসঙ্গে ভোটের দিক থেকেও পিছিয়ে পড়বে বিএনপি।

২০১৬ সালে বিএনপির ইফতারে মির্জা ফখরুলের সঙ্গে জামায়াতের নেতার কুশল বিনিময় 

 ‘প্রশ্নটা জামায়াত বা অ-জামায়াত না। প্রশ্নটা হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়ার স্ট্রাগল’—এ প্রসঙ্গে বলছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুবউল্লাহ। তার ভাষ্য, ‘ক্ষমতায় যেতে যত সম্ভব বন্ধু পারো সঙ্গে নিতে হবে। আর বিপরীত পক্ষের বন্ধু কমাও। যুদ্ধের মধ্যেও এই নিয়ম। রাজনীতিও রক্তপাতহীন যুদ্ধ।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে বিভিন্ন সময় এ প্রতিবেদকের আলাপ হয়। এসব আলাপে তারাও স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন—জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে সঙ্গে করে আগামী দিনে ক্ষমতারোহণ করা অসম্ভব।

এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করেন চেয়ারপারসন কার্যালয়ের প্রভাবশালী একজন দায়িত্বশীল। তিনি জানান, পরাশক্তিরা চায় জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির অ্যালায়েন্স ভেঙে যাক। বিশেষ করে দলীয় চারিত্রিক বৈশিষ্টগুলো দুইদলেরই বিপরীত হওয়ায় দেশি-বিদেশি শক্তিগুলো এ বিষয়ে জামায়াত ত্যাগের পক্ষে।

১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের তৎকালীন চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পরে ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে জোটত্যাগ করেন এরশাদ। ওই সময় জাপার মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে একটি অংশ থেকে যায় জোটে। এই জোটের মাধ্যমে নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি। ক্ষমতায় এসে কেবল জামায়াতকে নিয়ে সরকার গঠন করে তারা।

সূত্রের দাবি, এই অবস্থা বিএনপির জন্য কখনও স্বস্তিদায়ক ছিল না। যার রেশ এখনও টেনে চলেছে বিএনপি। পরবর্তীতে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চারদলীয় জোটের বর্ধিত ‘১৮ দলীয় জোটে’র ঘোষণা দেন খালেদা জিয়া। ওই জোটে প্রতিষ্ঠাকালীন শরিক জামায়াত, খেলাফত মজলিসসহ আরও কয়েকটি দল অংশ নেয়। সর্বশেষ   ২০২১ সালের (১ অক্টোবর) শুক্রবার ২২ বছর ৯ মাসের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে খেলাফত মজলিস।

‘দেশি-বিদেশি এক্সপার্টদের মতামত নিচ্ছে বিএনপি’

সূত্রের দাবি, জামায়াতকে নিয়ে খালেদা জিয়ার জোট গঠনের বিষয়টি কোনও আলোচনার বা স্টাডির মধ্যে হয়নি। দেশি-বিদেশি পরাশক্তিগুলোর মত নিয়েও স্টাডি করা হয়নি। প্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জামায়াতকে জোটে টানেন খালেদা জিয়া। যদিও কাজী জাফরও শেষ পর্যন্ত বিএনপি-জোটে থাকেননি।

স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরই স্থায়ী কমিটির বৈঠক এজেন্ডাভিত্তিক হয়। ২০১৯ সালের শুরুতে এসে জামায়াত ইস্যুটি কমিটির বৈঠকের এজেন্ডাভুক্ত হয়; সেই আলোচনা এখনও অব্যাহত আছে। এই বিষয়ে বক্তব্য রাখবেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে বাকি অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে অধিকাংশই জামায়াত ত্যাগের পক্ষে মত দিয়েছেন।

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক দায়িত্বশীল  বলেন, জামায়াত ইস্যুটিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে নির্মোহভাবে এগুচ্ছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। এক্ষেত্রে দলের অভ্যন্তরের মতামত গ্রহণের পাশাপাশি বিদেশি কয়েকজন বিশেষজ্ঞকেও কাজে লাগানো হয়েছে। এক্ষেত্রে শীর্ষ নেতৃত্বের চূড়ান্ত চেষ্টা জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক পৃথকের।

নির্ভরযোগ্য একজন দায়িত্বশীলের ভাষ্য, সর্বশেষ গত কয়েকবছর ধরে জামায়াতের সংগঠন গোছানোর অবাধ কার্যক্রম, সাঈদী মুক্তি ইস্যু ও জামায়াত নিষিদ্ধের আইনটি স্থগিত রাখাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জামায়াতের কার্যক্রম বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সন্দেহের নজরে পড়ে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির কোনও সদস্যই এ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি নন। তাদের প্রায় প্রত্যেকের ভাষ্য, জামায়াতকে বের করে দেওয়ার কোনও ব্যাপার নেই। যে জোটে তারা আছে, সেটি নিষ্ক্রিয়। আর এ বিষয়ক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।

 জামায়াতের উচ্চপর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল বলেন, ‘জামায়াতে বিএনপি জোট ছেড়ে দেওয়ার কোনও আলোচনা নেই। জোট ভাঙলে সেটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ভাঙতে হবে। আর দেশের ডানপন্থী ব্লকের কাছে ব্যাখ্যার করার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। যদি জোট সিদ্ধান্ত নেয়— এই জোট রাখবে না, তাহলে ওকে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট কেবল ভোটের অংকে হয়নি; জাতীয়তাবাদী-ইসলামপন্থী আদর্শিক ঐক্যমতও ছিল। বিএনপির মধ্যেও ডানপন্থী অংশটি এই জোট চায়।’

বিএনপি-জামায়াত জোট সম্পর্কের বিষয়ে  জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘২০ দলীয় জোট হচ্ছে নির্বাচনি জোট। বিএনপির সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কোনও পক্ষের কাছ থেকেই এ সংক্রান্ত বক্তব্য আসেনি। দুদলের মধ্যে বহু বিষয়ে মতের ভিন্নতা রয়েছে, ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক।’বাংলা ট্রিবিউন।

Check Also

তাবলীগ জামায়াতের সাদপন্থীদের নিষিদ্ধের দাবিতে সাতক্ষীরায় বিক্ষোভ-সমাবেশ

মুহাম্মদ হাফিজ, সাতক্ষীরা : তাবলীগ জামাতে সাদপন্থীদের বর্বোরিচত হামলার প্রতিবাদ ও সাতক্ষীরা জেলা আ.লীগের সহসভাপতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।