এটা হয়তো মন্ত্রীর সরল স্বীকারোক্তি। কিন্তু এই স্বীকারোক্তির ভেতরেই লুকিয়ে আছে নির্মম বাস্তবতা। মানুষের ভেতরে যেহেতু এ নিয়ে ক্ষোভ আছে, ফলে তার এই বক্তব্য দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শুরু হয় সমালোচনা। রসিকতা।
একজন লিখেছেন– ‘রাষ্ট্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ধনী গরিবের ব্যবধান ঘুচে যাচ্ছে। সবাই এভাবে একদিন লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনবেন।’
কারও মতে, যারা দরিদ্র, তারাও ভালো পোশাক পরছেন। এটাও হয়তো উন্নয়নের সূচক।
একজন কবি বরিশালে একটি রসাত্মক গল্প লিখেছেন–
প্রশ্ন: রোগীর এখন অবস্থা কী?
উত্তর: অনেক ভালো। আগে প্রস্রাব পায়খানা বাইরে গিয়ে করতো। এখন করে ঘরে।
কেউ কেউ ভালো পোশাক পরা মানুষের টিসিবির লাইনে দাঁড়ানোর ঘটনাকে মাথাপিছু আয় বাড়ার ফলাফল বলে মন্তব্য করেছেন।
একজন লিখেছেন, আগে দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষেরা টিসিবির লাইনে দাঁড়াতো। এখন মাশাআল্লাহ আমরা মন্ত্রী হয়ে ভালো ভালো পোশাক পরা মানুষদের দারিদ্র্যসীমার নিচে নামিয়ে টিসিবির লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি।
সম্প্রতি একটা কার্টুনও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে একজন লোক ভিক্ষা চাইছেন। স্যুট টাই পরা ভদ্রলোক তাকে প্রশ্ন করছেন, তোমার ২৫০০ ডলার কোথায় গেলো?
সাধারণ মানুষ ও শিল্পীদের এই যে রসিকতা, তার পেছনে রয়েছে মূলত অসন্তোষ, ক্ষোভ। নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে না পারা, বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে না পারা এবং সর্বোপরি ব্যবসায়ীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে গরিব মানুষের কষ্টকে প্রাধান্য দেওয়ার মতো মানবিক ও সংবেদনশীল নীতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুরোপুরি সফল না হওয়া কিংবা ত্রুটিপূর্ণ নীতি।
এটা ঠিক যে স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের প্রতি মানবিক ও সংবেদনশীল নীতির আলোকেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় অর্থাৎ টিসিবির মাধ্যমে তুলনামূলক কম দামে নিত্যপণ্য বিক্রি করা হয়। ঘনবসতিপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ এবং দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকায় টিসিবির ট্রাক থাকার কথা। কিন্তু সেখানেও নানা সমস্যার কথা গণমাধ্যমে আসে। যেমন, একই লোক বারবার পণ্য কিনছেন, যা ঠেকানোর মেকানিজম টিসিবির নেই। অনেক খুচরা দোকানদার এখান থেকে কম দামে পণ্য কিনে বেশি দামে বিক্রি করছেন। প্রতিদিন যে পরিমাণ পণ্যের চাহিদা, সেই পরিমাণ সরবরাহ নেই। যে কারণে অনেককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সম্প্রতি একটি ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থাকা টিসিবির একটি ট্রাক সেখান থেকে চলে যেতে থাকলে পণ্য কিনতে আসা অনেক লোক ট্রাকের পেছন পেছন দৌড় দেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানুষের আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে; করোনার অতিমারিতে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের অর্থনীতিও যেখানে বিপর্যস্ত, সেই তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে– সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। করোনার কারণে দীর্ঘমেয়াদে লকডাউন না দেওয়া এবং লকডাউনের ভেতরেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার প্রয়াস নিঃসন্দেহে পরিণত ও জনবান্ধব রাষ্ট্রীয় নীতি তথা শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদাহরণ। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্রপরিচালকরা যখন মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সুসংবাদ দেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখান, তখন টিসিবির স্বল্পমূল্যে পণ্য বিক্রির ট্রাকের পেছনে মানুষের লাইন কেন দীর্ঘ হবে?
মাথাপিছু আয় এবং কম দামে জিনিস কেনার লাইন একইসঙ্গে দীর্ঘ হওয়াটা কি সাংঘর্ষিক নয়?
বস্তুত আয় বাড়ছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি জীবনযাপনের ব্যয়ও বেড়েছে। ধরা যাক, কারও মাসিক আয় এক হাজার টাকা বাড়লো, কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় যদি বাড়ে এক হাজার একশ’ টাকা, তাহলে ওই এক হাজার টাকা আয় বৃদ্ধির কোনও মানে হয় না।
মাথাপিছু আয় বরাবরই একটা বিতর্কের ইস্যু। কারণ, এটি গড় হিসাব। ধনী গরিব সবার আয় এবং জাতীয় উৎপাদন যোগ করে যে গড় করা হয় সেটিই মাথাপিছু আয়। তাতে কারও মাসিক আয় হয়তো এক কোটি টাকা, সেখানে হয়তো অবৈধ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকাও আছে। পক্ষান্তের একজন দিনমজুরের মাসিক আয় যদি হয় ১৫ হাজার টাকা, তাহলে ওই এক কোটির সঙ্গে এই ১৫ হাজার যোগ করে যদি দুজনের গড় আয় বের করা হয়, সেটা অর্থনীতির ভাষায়ও হাস্যকর। কিন্তু তারপরও মাথাপিছু আয়ের একটা গুরুত্ব আছে। এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক স্ট্যান্ডার্ড বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল সমস্যা হচ্ছে আয় বৈষম্য। এখানে অবৈধ পথে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে একটি গোষ্ঠী, যে টাকার বিরাট অংশই জনগণের ট্যাক্সের পয়সা। অর্থাৎ যে টাকা লুটপাট হয় সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প এবং কেনাকাটায়। এই লুটপাটের টাকা আবার চলে যায় বিদেশে। কানাডার বেগমপাড়ায়, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে কিংবা কিছু টাকা খরচ হয় দেশের ভেতরেই বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কেনা এবং রাজকীয় রিসোর্ট তৈরিতে। কিন্তু এর বাইরে যে বিশাল জনগোষ্ঠী, যারা দুর্নীতি ও লুটপাটের সঙ্গে যুক্ত নয় বা সেই সুযোগও যাদের নেই, তারাই আবার করোনা মহামারি শুরু হলে কাজ হারায়, বেকার হয়, বেতন কমে যায়। সংসারের খরচ সামলাতে না পেরে পরিবার পরিজনকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে ঢাকায় একা থাকেন কিংবা পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে নিজেও চলে যান। করোনার পিক সময়ে দেখা গেছে অসংখ্য মানুষ ট্রাকে করে আসবাবপত্র নিয়ে ঢাকা শহর ছেড়ে চলে গেছেন। সুতরাং টিসিবির লাইন তো দীর্ঘ হবেই। অন্যদিকে অর্থনীতির নানা সূচকে দেশ যেহেতু এগিয়ে যাচ্ছে, ফলে পরিসংখ্যান অনুযায়ী মাথাপিছু আয়ও বাড়ছে।
একদিকে করোনা মহামারির ধাক্কা, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, এ দুই সংকটে বিপর্যস্ত যে বিরাট জনগোষ্ঠী, মূলত তাদের কারণেই টিসিবির লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। একদিকে আয় বন্ধ কিংবা হ্রাস, অন্যদিকে সব জিনিসের দাম বৃদ্ধির এই শাঁখের করাতে চেরাই হতে হতে মধ্যবিত্তও চলে আসছেন নিম্নবিত্তের জন্য নির্ধারিত টিসিবির লাইনে। চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশিরভাগ পণ্যের দামই বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বেড়েছে পরিবহন ব্যয়। বাসা ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষার খরচও অনেকাংশে বেড়েছে। এরইমধ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া। তার মানে টিসিবির লাইনে ভালো পোশাক পরা লোকের লাইন আরও দীর্ঘ হবে।
করোনার ধাক্কায় সরকারি কর্মচারী এবং কিছু খাতের ব্যবসায়ী (খাদ্যপণ্য ও মেডিকেল) ছাড়া কেউই স্বস্তিতে নেই। অসংখ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে গণহারে কর্মী ছাঁটাই, বেতন কমানো এবং বেতর বন্ধের খবর কারও অজানা নয়। সুতরাং দারিদ্র্য না বাড়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু তারপরও নাকি মাথাপিছু আয় বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে এখন বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ২৫৫০ ডলার।
মুশকিলটা হলো, ১৭ কোটি মানুষের দেশে এক কোটি মানুষও যদি বৈধ অবৈধ নানা তরিকায় বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয় এবং তখন মাথাপিছু আয় যদি ৫০০০ ডলারও ছাড়িয়ে যায়, তারপরও টিসিবির লাইনে মানুষের সংখ্যা কমবে কিনা, তা বলা কঠিন।
নিত্যপণ্যের দাম একেবারে প্রান্তিক মানুষের ক্রয়সীমার নাগালে রাখাই হচ্ছে একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। কিন্তু আমাদের দেশের মতো অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনীতির দেশে একেবারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের যে দাম, তা যথেষ্ট বেশি এবং এই খাতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ যে অত্যন্ত দুর্বল, তা বোঝার জন্য গবেষণার প্রয়োজন হয় না। যদিও নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করা হচ্ছে। পাশাপাশি জাহাজ ভাড়া বেড়েছে, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এরকম পরিস্থিতিতে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সরকার কী করছে?
বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। শেষ করা যাক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের বক্তব্য দিয়ে। গত ৯ জানুয়ারি রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ঢাকা ওয়াসা আয়োজিত ‘বিল কালেকশন অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘চলতি বছরে মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে’। মন্ত্রী বলেন, ‘গত একযুগে আমাদের গড় আয় ম্যাজিকের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে…।’
তবে মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেলেও নিত্যপণ্যের দামও যে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে এবং এর ফলে ওই মাথাপিছু আয়ের নিচে যে স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়বে; টিসিবির লাইন যে আরও দীর্ঘ হবে, মন্ত্রী সে কথা বলেননি।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।