আজ থেকে শুরু হচ্ছে স্বাধীনতার সেই অগ্নিঝরা মার্চ মাস। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তি পেরিয়ে বাংলাদেশ অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত আজ। এখন বিজয়ের সুফল ভোগ করতে চায় সাধারণ জনগণ। ক্ষুধা, দারিদ্র ও বৈষম্যমুক্ত সাম্য, মানবিক সম্মান এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের সোনার বাংলা দেখতে চায় স্বাধীন বাংলার সাধারণ মানুষ।
বর্ষপরিক্রমায় প্রতিটি মাসে এমন কিছু দিবস আছে, যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয়। আর অগ্নিঝরা মার্চ আমাদের জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই মার্চে রচিত হয়েছে এমন কিছু ইতিহাস, যা বাঙালির পরিচয়সূত্রে গেঁথে আছে। ১৯৭১ সালের এই মার্চে স্বাধীনতাকামী বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে।
একাত্তরের মার্চে মুক্তি ও স্বাধীনতার দাবিতে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে এই মার্চ দিয়েছে গৌরবদীপ্ত মুক্তিযুদ্ধের আস্বাদ। এ মাসেই উত্তোলিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা। পঠিত হয়েছিল স্বাধীনতার ইশতেহার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম মহাকাব্য রচনা করেছিলেন বাঙালির হাজার বছরের অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষার এই পঙ্ক্তিমালা উচ্চারণ করে- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি- বাঙালি আর পরাধীন নয়।
মার্চের শুরু থেকেই সব বাঙালির কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, লড়াই করেই অধিকার আদায় করে নিতে হবে। ১৯৭১ সালের এই মাসের প্রতিটি দিন স্মরণযোগ্য। ১ মার্চ এক হঠকারী সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা দেশে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে সবুজ জমিনের ওপর লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনালি মানচিত্রখচিত প্রথম জাতীয় পতাকা তোলা হয়েছিল। ৪ মার্চ জনগণের মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন সাংবাদিক ও শিল্পীরা। ৫ মার্চ টঙ্গীতে গুলিবর্ষণে চারজন নিহত ও ২৫ জন আহত হন। ৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের ডাক দেন। জরুরি বৈঠকে বসে আওয়ামী লীগ। ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ’ এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বাঙালিকে। ওই এক ভাষণেই দিকনির্দেশনা পায় দেশের জনগণ। বুঝে যায় অধিকার আদায় করে নিতে হবে। ১২ মার্চ কবি সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে মহিলা পরিষদের এক সভায় পাড়ায় পাড়ায় মহিলা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আহ্বান জানানো হয়। ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন ইয়াহিয়া খান। মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। ২৩ মার্চ দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। ২৫ মার্চের কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বর্বর ও হিংস্র পাকিস্তানি সেনারা। শুধু ঢাকায়ই হত্যা করে এক লাখের বেশি মানুষকে। গ্রেপ্তার করা হয় মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তবে গ্রেপ্তারের আগে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যে ঘোষণাটি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান পাঠ করে জনগণকে জানান দেন।
২০২০ সালে স্বাধীনতার এ মাসেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পালিত হয়েছে। আজ মার্চের প্রথম দিনেই সাম্য ও সুশাসনের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমাদের সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার শপথ নিতে হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী সার্থক করতে হবে, সুফল পাওয়ার সুযোগ দিতে হবে সর্বসাধারণকে।
এই অগ্নিঝরা মার্চকে স্মরণ করতে মাসজুড়েই বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং পেশাজীবী সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে। এসবের মধ্যে রয়েছে আলোচনা সভা, চিত্রপ্রদর্শনী, আবৃত্তি সন্ধ্যা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে রচনা ও ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা। এসবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তির পরেও একাত্তরের মার্চ জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠবে বাঙালির সামনে। এই প্রত্যাশায়…।
বিলাল হোসেন মাহিনী
নির্বাহী সম্পাদক, ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর।