আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির তালিকায় সুন্দরবনের খলিশা ফুলের মধু গত কয়েক বছর ধরে বিদেশে রপ্তানি হয়ে আসছে। বিশ্বজুড়ে সুন্দরবনের এ মধুর কদর বাড়ছে। ফলে দিনের পর দিন এর চাহিদাও বাড়ছে কয়েক গুণ। উপকূলীয় জেলা,সাতক্ষীরা,খুলনা ও বাগেরহাটা অঞ্চলের মানুষদের জীবন-জীবিকার অন্যতম মাধ্যমহয়ে উঠেছে সুন্দরবন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব অঞ্চলের মৌয়ালরা সুন্দরবনে যান মধু সংগ্রহ করতে। ১৮৮৬ সাল থেকে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রোডে অনুষ্ঠান করে প্রতিবছর ১ এপ্রিল থেকে মধূ সংগ্রহ শুরু হয় অনুষ্ঠানিক ভাবে। কিন্তু চলতি বছরে ১৫ দিন এগিয়ে ১৫ মার্চ থেকে শুরু হচ্ছে সুন্দবনের মধূ সংগ্রহের মৌসুম। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খলিশা ফুলের মধু আগের চেয়ে ১৫-২০দিন আগেই সংগ্রহ করার উপযুক্ত হচ্ছে। এদিকে খলিষা ফুলের মধূর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে সুন্দরবন–সংলগ্ন আশপাশের এলাকায় সুন্দরবনের খাঁটি মধুর নামে খুশে বসেছে ভেজাল মধুর ব্যবসা। একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী চক্র অতি মুনাফার আশায় সুন্দরবন থেকে সংগৃহীত মধুতে ভেজাল দিয়ে বাজারে তা উচ্চ দামে বিক্রি করছে। ভেজাল মধু শনাক্ত করার সাধারণত কোনো উপায় না থাকায় পর্যটকসহ ক্রেতাসাধারণ তা কিনে প্রতারিত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অসাধু ব্যবসায়ী চক্রটি সুন্দরবনে মধু আহরণ মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই মৌয়ালদের মোটা অঙ্কের টাকা দাদন দেয়। দাদনবাজ ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা লাভের আশায় বনের অভ্যন্তরে থাকা অবস্থাতেই সংগৃহীত মধুর সঙ্গে চিনির শিরা ও অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে পরে লোকালয়ে আনতে বলে দেয়। মৌয়ালদের একাংশ ভেজাল মধু তৈরির উপকরণ, সরঞ্জামসহ মৌসুমে বনে প্রবশ করে।
সুন্দরবনের খলিশা গাছের ফুলের মধু সব থেকে বেশি আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয়। দামও বেশি এই মধুর। সুন্দরবনের অনেক গাছপালার ভিড়ে ছোট থেকে মাঝারি গড়নের একটি গাছ হলো খলিশা। প্রায় ৫-৭ মিটার পর্যন্ত বাড়ে। সুন্দরবনে খলিশা সব জায়গায় দেখতে পাওয়া যায় না।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন উপকূলীয় দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। ইউনিয়নের ৪০ হাজার বাসিন্দাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ সুন্দরবন ও উপকূলীয় নদীর উপর নির্ভরশীল। গাবুরা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের সোরা গ্রামের বাসিন্দা আকরাম। সুন্দরবনে গিয়ে মধু সংগ্রহ করেন এই মৌয়াল। তিনি জানিয়েছেন সুন্দনবন থেকে মধু সংগ্রহের প্রক্রিয়া, অভিজ্ঞতা ও প্রতিবন্ধকতা। আকরাম জানান, মধু সংগ্রহ করতে যাওয়ার আগে প্রথমে ঠিক করা হয় ১০-১২ জনের একটি মৌয়াল দল। মহাজনের কাছ থেকে সুদ হিসেবে টাকা নিয়ে লাখ টাকায় এক মাসের জন্য নৌকা ভাড়া করা হয়। এরপর নৌকায় পর্যাপ্ত খাদ্য সামগ্রী ও প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে গহীন সুন্দরবনের মধ্যে সুবিধাজনক স্থানে যাওয়া হয়। একটি জায়গায় নৌকা নোঙর করে ভাগ হয়ে ডুকে পড়া হয় সুন্দরবনের গহীনে।
কিছুক্ষণ পর পর কু কু শব্দে সংকতে দিয়ে সকলের অবস্থান নিশ্চিত করা হয়। ৫০-১০০ হাত দূরত্বে প্রতিজন খুঁজতে থাকে মৌমাছির আস্থানা। একজন একটি আস্তানা খুঁজে পেলে সংকেত দিয়ে সকলকে একত্রিত করেন। তিনি বলেন, মধু রাখার পাত্রটি যিনি বহন করেন তাকে বলা হয় কাড়িয়ালা। আর মৌচাক থেকে মৌমাছি তাড়ানোর কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে বলা হয় কাড়–য়ালা আর একজন মধু কাঁটে। তিনটি ভাগে বিভক্ত মৌয়াল দলটি। মধু সংগ্রহ করলে কাড়িয়ালা সেই মধু নৌকায় গিয়ে রেখে আসে।
তিনি আরও বলেন, লাখ টাকা সুদে নেওয়া মহাজনের কাছে মধু বিক্রি করলে প্রতি মণ মধুর মূল্য দেওয়া হয় ১০-১২ হাজার টাকা। সেই মধুর বাজারমূল্য ১৫-১৬ হাজার টাকা। মহাজনের কাছে বিক্রি না করলে মধু বিক্রির টাকায় ভাগ দিতে হয় মহাজনকে। ”জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংগ্রহ করা এই খলিশা ফুলের মধু বিক্রি করি ৩৫০-৩৮০ টাকায়। প্রভাবশালীরা অল্প দামে নিয়ে বাইরে বেশি দামে বিক্রি করে। এরপর তা চলে যায় রাজধানীসহ সারাদেশে। এ ছাড়া সুন্দরবনের মধুর নামে ভেজাল মধুও রয়েছে বাজারে।” যোগ করেন তিনি।
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের প্রতিবন্ধকতার কথা জানিয়ে মৌয়াল আকরাম আরো জানান, ‘বনবিভাগ থেকে বিএলসি (বোর্ট লাইসেন্স সার্টিফিকেট) নিয়ে মৌয়ালরা সুন্দরবনে প্রবেশ করে। অধিকাংশ মৌয়ালরা সুন্দরবনে ঢুকে যায় চুরি করে। বিএলসি নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশের পরও সুন্দরবনের গহীনে বন বিভাগের ফরেষ্টারদের নৌকা প্রতি সপ্তাহে এক হাজার টাকা করে দিতে হয়। এ ছাড়া প্রতি মধুতে ভাগ দিতে হয় দুই কেজি। মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে অনেক মৌয়ালকে বিভিন্ন সময় প্রাণ হারাতে হয়েছে।’
তবে নৌকা প্রতি টাকা ও মধু নেওয়ার বিষয়ে সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক বলেন, ‘এমন অভিযোগের প্রমাণ দিতে পারলে সেই ফরেষ্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সুন্দরবনের মৎস্য ব্যবসায়ী ও দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সম্পাদক কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সুন্দরবনের মৌয়ালদের কারও কারও বিরুদ্ধে ভেজাল মধু তৈরির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ বিষয়ে বন বিভাগের উদাসীনতাও বরাবরেরই। তাদের অবশ্যই এ বিষয়ে কঠোর হওয়া উচিত। এদিকে গতবছরের ১২ মে পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকার বাদেরজেলে এলাকা থেকে ভেজাল মধু তৈরির সারঞ্জাম ও ১৫ বস্তা চিনিসহ ৭ মৌয়ালকে আটক করে বন বিভাগ।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, বেশ কয়াক বছর ধরে খলিশা ফুল আগে আসছে। ফলে মধুও আগে পাওয়া যাচ্ছে। তবে মধূ সংগ্রহের নামে কোন প্রতারণা হলে তা কঠোর হচ্ছে প্রতিহত করা হবে।
Check Also
সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান
নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। …