নদীমাতৃক বাংলাদেশের উত্তরের জেলা দিনাজপুর। এই জেলার নদীর জল সেচের কাজে ব্যবহার করে কৃষকরা ফসল ফলানোর স্বপ্ন বোনেন। পাশাপাশি জেলেরাও নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু তাদের স্বপ্নের এই নদীগুলো বর্তমানে ভরাট হয়ে মৃতপ্রায়। বালুর চর জমে সংকীর্ণ হয়ে গেছে। পানি না থাকায় কৃষকরা সেচের সংকটে পড়েছেন। আর মাছ কমে যাওয়ায় বিপাকে মৎস্যজীবীরা। এদিকে, নদীতে পানি না থাকায় নেমে গেছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর। ফলে গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ দিচ্ছেন কৃষকরা। এ জন্য বেড়ে যাচ্ছে ফসলের উৎপাদন খরচ। নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় এবং খনন না হওয়ার কারণে পানি ভূ-গর্ভে প্রবেশ করছে না। এ কারণে নেমে যাচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্থিতিতল।
দিনাজপুরের পুনর্ভবা, আত্রাই, গর্ভেশ্বরী, কাকড়াসহ বিভিন্ন নদী ঘুরে দেখা গেছে, নদীগুলোতে পানি নেই বললেই চলে। খরস্রোতা নদীগুলো এখন পরিণত হয়েছে ছোট নালায়। নদীর বড় অংশ জুড়েই পলি পড়ে ভরাট হয়েছে। অনেকেই সেই পলিতে চাষাবাদ করছেন, অনেক চরই ব্যবহৃত হচ্ছে খেলার মাঠ হিসেবে। শুধু বর্ষাকাল ছাড়া সব সময়ই এমন চিত্র বিরাজ করে। দীর্ঘ দুই যুগেও কোনও নদী খনন কার্যক্রম করা হয়নি। ফলে বছরের পর বছর ধরে এসব নদী মরা খালের মতো অবস্থা ধারণ করেছে। এই অবস্থাতে বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই নদীর পানি উছলে পড়ে নদীর আশেপাশের এলাকা প্লাবিত করে বন্যার আকার ধারণ করছে। আর খরা মৌসুমে ওইসব নদী থেকে যেখানে চাষাবাদ হতো সেসব জমিতে পানি সেচের সংকটে পড়েছে। একই সঙ্গে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্থিতিতলও নিচে নেমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। এমন অবস্থায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষিজীবী ও মৎস্যজীবীরা।
দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার তেরো মাইল গড়েয়া এলাকার আব্বাস আলী বলেন, ‘আগে আমাদের বাবা-দাদারা নদীতে মাছ ধরতেন। কত মাছ! আর এখন নদীতে মাছও নেই, জলও নেই। এখন নদীতে খালি গরু ঘাস খায়। এখন নদীতে মাছ ধরতে আসলে বিরক্ত লাগে। মাছ না থাকলে ভালো লাগে?’
এলাকার দ্বিজেন দাস বলেন, ‘আমাদের জন্য মাছ থাকবে তো? নদীতে পানি থাকবে তো? আমরা তেরো মাইল গড়েয়া থেকে মাছ ধরতে এসেছি পুনর্ভবা নদীতে। আমরা মাছ ধরেই সংসার চালাই। আগে আমার বাবা অনেক মাছ পেতেন এই নদীতে, কিন্তু এখন মাছ কই? আর দেখা পাই না মাছের। নদী খননের পাশাপাশি আমাদের কথা চিন্তা করে সরকার যেন এই নদীতে একটু মাছের ব্যবস্থা করে দেয়। তা না হলে আমাদের অভাব ফুরাবে না।’
জেলার সদর উপজেলার গাবুড়া নদীর (গর্ভেশ্বরী নদী) জলে নিজের ফসল আবাদ করে শেখপুরা ইউনিয়নের গোপালপুর এলাকার মজিবর রহমান। তিনি বলেন, ‘নদীতে চারিদিকে চর জমে গেছে। জলের আর দেখা পাই না। এই নদীতে আগে জলের স্রোত দেখা যেত। কিন্তু এখন নেই। ২০০১-০২ সালের দিকে এই নদীতে আগের ব্যবহৃত নৌকা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এখন নৌকা তো দূরের কথা। সেচের জন্য জলও পাই না। বাধ্য হয়ে নদীতেই বর্ডিং (অগভীর নলকূপ) করে সেচ দিতে হয়।’ তিনি নদীতে পানিপ্রবাহের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
একই দাবি দিঘন এলাকার ইকবাল হোসেনের। তার মনেও নদীতে জল নিয়ে প্রশ্ন। তিনি বলেন, ‘নদীর পানিতে সেচ দিয়ে আমার মতো অনেক কৃষকই ফসল আবাদ করেন, কিন্তু এখন নদীতে পানি থাকে না। ইরি আবাদের সময় তো আকাশের পানি পাওয়া যায় না। পাতালের পানি, নইলে নদীর পানি। কিন্তু পাতালে পানি নিতে গেলে খরচ বেশি। লেয়ার থাকে না। নদীতে ভাসা পানি সহজে পাওয়া যায়। সরকার নদী খনন করলে আমরা বাঁচতে পারবো।’
কৃষক বেনুরাম সরকার বলেন, ‘এই মুহূর্তে বড় সমস্যা হলো ভূগর্ভস্থ পানিও ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে। আর এই কারণে আমাদের ফসল উৎপাদনে বেশি খরচ হচ্ছে।’
দিনাজপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের হিসাব বলছে, প্রতি বছরই খরা মৌসুমে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্থিতিতল তিন থেকে ছয় ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে। আর প্রতি পাঁচ বছরে নামছে স্থানভেদে এক থেকে দুই ফুট পর্যন্ত নামছে। শুধু খরা মৌসুমেই নয়, পানির স্থিতিতল নিম্নগামী বর্ষা মৌসুমেও। যার প্রতিফলন লক্ষ করা যাচ্ছে ফসলের মাঠে। এখন শুধু বোরো মৌসুমেই নয়, আমন মৌসুমেও যন্ত্রের মাধ্যমে পানি সেচ দিতে হচ্ছে কৃষকদের। দফতরটির তথ্যমতে, গত ১০ বছরে দিনাজপুর জেলায় স্থানভেদে পানির স্থিতিতল নেমেছে দুই থেকে চার ফুট পর্যন্ত। আর পানির স্থিতিতল যতই নিম্নগামী হবে, ততই বাড়বে সেচ খরচ। অর্থাৎ আগের তুলনায় পানি সেচের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে স্থানভেদে ছয় থেকে আট শতাংশ পর্যন্ত। ফলে কৃষি উৎপাদনে উভয় সংকটের মধ্যে পড়েছেন উত্তরের জেলা দিনাজপুরের কৃষকরা।
এদিকে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে নদীর সংখ্যা রয়েছে ১৯টি। সাম্প্রতিক সময়ে এই নদীর খনন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই জেলার পুনর্ভবা, আত্রাই, ঢেপা, গর্ভেশ্বরী, ছোট যমুনা, ইছামতি নদীর খনন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মধ্যে আত্রাই ও পুনর্ভবা নদীর খনন কার্যক্রম করছে বাংলাদেশ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়।
আর জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ৫ বছরের হিসাবে জেলায় মাছের চাহিদা বেড়েছে। বেড়েছে মানুষের সংখ্যাও। তবে সেইভাবে বাড়েনি মৎস্যজীবীর সংখ্যা। হিসাব বলছে, ২০১৬ সালে জেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৫৭ জন, ২০২১ সালে তা হয়েছে ১১ হাজার ৯১২ জন। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাছের উৎপাদন ছিল ৪২ হাজার ৫৫১ মেট্রিক টন সেখানে গত অর্থবছরে (২০১৯-২০২০) উৎপাদন হয়েছে ৫৬ হাজার ৯৬৫ মেট্রিক টন। যদিও জেলায় মাছের চাহিদা ৬২ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি। জেলায় ১২টি মৎস্য অভয়াশ্রম রয়েছে। তবে নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় খরা মৌসুমে সেগুলোতেও সমস্যায় পড়তে হয়।
দিনাজপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মুক্তাদির খান বলেন, ‘গত কয়েক বছরে জেলায় মাছের উৎপাদন বেড়েছে, বেড়েছে জেলের সংখ্যাও। অভয়াশ্রম ও রাবার ড্যামের ফলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক জেলেই তাদের পেশা পরিবর্তন করছেন। ফলে জেলের সংখ্যা সেভাবে বাড়ছে না। তবে নদীগুলোর খনন কার্যক্রম হলে অবশ্যই মাছের পরিমাণ বাড়বে।’
দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক নদীরই খনন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এগুলোর খনন মূলত করছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। কিছু খনন হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে। নদীগুলো খনন হলে খরা মৌসুমেও পানি পাওয়া যাবে এবং কৃষি ও মৎস্যের উপকার হবে।’
দিনাজপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সদ্য বিদায়ী নির্বাহী প্রকৌশলী মুরাদ হাসান বলেন, ‘ভূ-গর্ভস্থ পানির স্থিতিতল নিচে নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ নদী থেকে পানি ভূগর্ভে রিচার্জ হচ্ছে না। নদীতে পানি থাকলে সেই পানিই ভূগর্ভে প্রবেশ করে। নদী থেকে ভূগর্ভে পানি রিচার্জ হওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।’