আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। আর্সেনিক ও লবণাক্ততায় জটিল রোগ দেখা দিচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে মিষ্টি পানির আধার। যে কারণে উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। আর ভূগর্ভস্থ পানির অপরিকল্পিত উত্তোলনে এ সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। ফলে সুপেয় পানির উৎস সংকুচিত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে বিশ্বে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পানির চাহিদা। ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, নিরাপদ উৎস থেকে পানি সংগ্রহের সুযোগ নেই এমন ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশে বর্তমানে প্রায় তিন কোটি মানুষ নিরাপদ পানি সুবিধার বাইরে। যার বেশির ভাগই বাস করে উপকূলীয় অঞ্চলে। বিভিন্ন সংস্থার একাধিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আইলাদুর্গত এলাকার ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বর্তমানে পানযোগ্য পানিবঞ্চিত। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি এবং খুলনা জেলার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার ১৯ ইউনিয়নে বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট। মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ মানুষ নলকূপের মাধ্যমে পানি পাচ্ছে। এখনও ৭৮ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে না। আর মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ পুকুর লোনাপানি মুক্ত।সংশ্লিষ্টরা বলছে ২০৫০ সাল নাগাদ ৯৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ৭০০ কোটি মানুষ পানির সমস্যায় পড়বেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সংকটের অন্যতম সুপেয় পানি। উপকূলীয় এলাকায় এ সংকট সর্বাধিক। সেখানে সুপেয় পানির আধার কম। তার ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেই আধারগুলো নষ্ট হচ্ছে। ফলে সংকট প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলে সিডর, আইলা, নার্গিস, বিজলীসহ পাঁচটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। এতে মিষ্টি পানির আধার নষ্ট হয়ে নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। ফলে উপকূলের মানুষকে খাবার পানির জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে। সংকট মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বায়ো সেন্ড ফিল্টার, পিএসএফ (পুকুরপাড়ে বালির ফিল্টার) ও রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং প্লান্ট এবং জলাধার সংস্কার প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও সেটি যথেষ্ট নয়।
এদিকে উপকূলের ১০ জেলার ৪৪ উপজেলায় দুই লাখ ছয় হাজার ৮৭২টি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেই বর্তমান সরকার। প্রতিটি ইউনিট স্থাপনে বরাদ্ধ রাখা হয় ৪৫ হাজার টাকা। ৯৬১ কোটি ৭৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা খরচ হবে এই প্রকল্পে। সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, চট্টগাম ও কক্সবাজার জেলায় দুই লাখ ছয় হাজার ৮৭২টি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ইউনিট স্থাপনে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৩০ কোটি ৯২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। প্রতিটি ইউনিট বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা। আবার ক্যাচমেন্ট সংস্কার বা ফিল্টার প্রতিটিতে সাত হাজার টাকা। ফলে প্রতিটি ইউনিটের জন্য ব্যয় ৫২ হাজার টাকা হবে। অন্য দিকে পরিবহনসেবা ক্রয়ের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৩৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এখানে প্রতি মাসে ব্যয় হবে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চরম ধীরগতি চলছে।
‘আমাদের বাড়ির টিউবয়েলের পানিতে লবণ ও আর্সেনিক। সেটার পানি ব্যবহার করা যায় না। এক কলস খাবার পানির জন্য প্রতিদিন আমাদের মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হয়। সেখানে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পুকুর পাড়ে স্থাপিত ফিল্টার থেকে এক কলস খাবার পানি সংগ্রহ করি। বৃষ্টির সময় ট্যাংকিতে কিছু পানি ধরে রেখেছিলাম। সেটা এখন শেষ হয়ে গেছে। এই পানি পান করে আমাদের শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়। তারপরও উপায় নেই, বাধ্য হয়ে পুকুরের পানি পান করি।’
কথাগুলো বলছিলেন সাতক্ষীরার উপকূলীয় উপজেলা আশাশুনির প্রতাপনগরের বাসিন্দা আনিছা বেগম। সাতক্ষীরা উপকূলের প্রায় সব গ্রামের নারীদের কথা একই রকম। তাদের দিনের বড় একটি সময় পার হয় এক কলস সুপেয় পানি সংগ্রহের পেছনে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকায় নলকূপের পানি লবণাক্ত। অনেকে পুকুরের পানি পান করে। বড় প্লাস্টিকের ট্যাংকে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হয়। কিন্তু তা দিয়ে বেশিদিন চলে না। বাধ্য হয়ে লবণাক্ত ও নোংরা পানি পান করে নানা রকম রোগে ভুগছে এখানকার মানুষ।
আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী আবু দাউদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসের সময় দুই দফা বেড়িবাঁধ ভেঙে আমার ইউনিয়নে টানা দুই বছর জোয়ার ভাটি হয়েছে। লবণ পানির কারণে এখানকার সুপেয় পানির উৎসগুলো একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। তবে এখনো মানুষের জন্য পর্যাপ্ত সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা যায়নি। এখানকার মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছে।
শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। এখানে বাইরে থেকে পানি আনা সম্ভব না। এখানকার নলকূপের পানি লবণাক্ত ও আর্সেনিকযুক্ত। এখানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পুকুর খনন, পন্ড ফিল্টার স্থাপনসহ নানা প্রকল্প নেওয়া হলেও সেটি পর্যাপ্ত নয়।
সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, গেল বছর ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানির চাপে খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে আশাশুনির প্রতাপনগর ও শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালীনি ও গাবুরা ইউনিয়নের কিছু এলাকায় নতুন করে লবণ পানি প্রবেশ করে। ফলে সেখানকার মিষ্টি পানির বিভিন্ন উৎস একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নতুন করে সুপেয় পানির উৎস তৈরিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
Check Also
আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি
এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …