বৈদেশিক ঋণের টাকায় প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ সফর এবং সরকারি অফিস নির্মাণে কঠোর আপত্তি দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এ দুই খাতে চাওয়া হয়েছে ১ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে বিদেশ সফরের জন্য চাওয়া হয়েছে প্রায় ৪৯ কোটি (৪৮ কোটি ৭৩ লাখ) টাকা। পাশাপাশি আপ্যায়নসহ আরও তিন খাতে ছিল অতিরিক্ত ব্যয়। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, ‘বাংলাদেশ এনভারমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (বেস্ট)’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮৩৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১ হাজার ২০৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে ২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা ব্যয় করার কথা। অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২৭ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নে লক্ষ্য রয়েছে। কিন্তু নানা রকম ত্রুটিপূর্ণ প্রস্তাবের কারণে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা করা হয়নি। বৃহস্পতিবার ফেরত দেওয়া হয়েছে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব)।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) শরিফা বেগমের যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পটিতে এতটাই ত্রুটিপূর্ণ প্রস্তাব ছিল যে, আমাদের কাছে মনে হয়েছে পিইসির আগেই সংশোধন হওয়া উচিত। এছাড়া ঋণের টাকা বিদেশ ভ্রমণ সমর্থনযোগ্য নয়। প্রশিক্ষণের প্রয়োজন থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে এত টাকা চাওয়া হয়েছে? এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বৈদেশিক ঋণের টাকা খরচে শ্রীলংকার কারণে সতর্ক হওয়ার বিষয় নয়। বিষয়টি হচ্ছে, নীতি-নৈতিকতা এবং দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার। এসব বিষয় বিবেচনা করে প্রকল্প প্রস্তাবটি ফেরত দেওয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ও ভ্রমণ মিলে চাওয়া হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জন্য ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা এবং সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের জন্য ৭ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। এই খাতে মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৪৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন বলেছে, কোভিড-১৯ ও বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রকল্পের আওতায় বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বাদ দিতে হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন অনুবিভাগ) সঞ্জয় কুমার ভৌমিকের কাছে বৈদেশিক প্রশিক্ষনের বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন এ বিষয়ে আমি এখনো তেমন কিছু জানি না। এর ভেতরে ঢোকা হয়নি। প্রকল্প প্রস্তাবটি এখনো খসড়া পর্যায়ে আছে।
এছাড়া প্রকল্প প্রস্তাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৩৮টি অফিস ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব রয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ একর। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন বলেছে, সরকারি অফিস নির্মাণে অর্থ বিভাগের রাজস্ব বাজেট ব্যবহার করাই যুক্তিযুক্ত। বৈদেশিক ঋণ নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সরকারি অফিস নির্মাণ কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। প্রকল্প প্রস্তাব থেকে এ ধরনের ব্যয় বাদ দিতে হবে। পরিকল্পনা কমিশন থেকে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পটির ব্যয় পর্যালোচনা করে কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এগুলো হলো-আপ্যায়ন খাতা খাতে মোট চাওয়া হয়েছে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের জন্য ৩৫ লাখ টাকা, বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য ৫০ লাখ, বিআরটিএর জন্য ৫০ লাখ এবং হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের জন্য চাওয়া হয়েছে ২০ লাখ টাকা। অন্যান্য সম্পদ খাতে ৫ কোটি টাকা এবং স্টেশনারি খাতে ৫ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। এসব ব্যয় অত্যাধিক মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। যৌক্তিকভাবে কমাতে হবে। ডিপিপিতে সংযুক্ত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনটি ও পরিকল্পনা বিভাগের জারি করা হালনাগাদ ফরম্যাট অনুযায়ী যথাযথভাবে তৈরি হয়নি। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ৯৪ জন জনবলের নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। কিন্তু প্রস্তাবিত জনবলের বিষয়ে অর্থ বিভাগের জনবলসংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সুপরিশ দেওয়া হয়নি। পরিবেশ এনডাউনমেন্ট ফান্ডের জন্য চাওয়া হয়েছে ৪২০ কোটি টাকা। এই ফান্ড কি কাজে ব্যবহার হবে তা বোধগম্য নয় বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশন আরও বলেছে, প্রকল্পটিতে বৈদেশিক অর্থায়নের নিশ্চয়তার বিষয়ে কোন তথ্য দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে ঋণ চুক্তি বা অন্যকোন ডকুমেন্ট ডিপিপিতে যুক্ত করা প্রয়োজন ছিল।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বেস্ট প্রকল্পে এমন ব্যাড প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। এই অবস্থায় পিইসি সভা করলে দেখা যাবে অনেক সময় নষ্ট হবে। তাই আগে প্রকল্পটি ফেরত দিয়ে ব্যাখা চাওয়া হয়েছে। এই পর্যায়ে বেশিরভাগ ভুলত্রুটি সংশোধন হয়ে আসলে ভালো হবে। তাহলে পরবর্তীতে পিইসি সভায় আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা সহজ হবে।