- গৌতম দাস
ইউক্রেন ইস্যুতে পরাজয়ে বাইডেন প্রশাসনের শেষ কামড় শুরু হয়েছে। সেটি অনুমান করে লিখেছিলাম বাইডেন এখন দক্ষিণ এশিয়ায় চাপ বাড়াবেন। তাকে ফল দেখাতে হবেই! বাংলাদেশ এই চাপের মধ্যে পড়বে। তা কেবল বাংলাদেশ নয়, আমাদের এই সারা অঞ্চলে প্রবলভাবে এই চাপের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আসন্ন এক প্রধান টার্গেট এখন ভারত। ভারতকে পক্ষে আনতেই হবে, এরই প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে আমেরিকা। কিন্তু এই চাপ কি কাজ করবে, না ভারতই হাতছুট হয়ে যাবে?
দুই সপ্তাহ আগে বাইডেনের ইউরোপ সফরের পর থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বাইডেন হেরে গেছেন। ইউরোপ বাইডেনের কথা মেনে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করতে পারছে না। বাইডেন বিকল্প দিয়েছিলেন যে, আমেরিকা নাকি ইউরোপকে তেল-গ্যাস জ্বালানিদাতা হতে চায়। এতে প্রো-আমেরিকান মিডিয়া আগেই বিপুল উচ্ছ¡াসে কাভারেজ দিলেও ইউরোপ মানে জার্মান-ফান্স-নেদারল্যান্ডসের ইউরোপ আনমুভড থেকে যায়। মানে, নিজেদের পুরনো অবস্থান যে, রাশিয়ার গ্যাসই তাদের লাগবেÑ সেটি আসলে থেকে যায়। অন্তত ২০২৪ সাল পর্যন্ত নাকি তাদের থাকতেই হবে; না হলে তারা বিরাট অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়বে, এই তাদের বক্তব্য ও অবস্থান।
এটা হলো, ইউরোপ বাইডেনের কথায় আনমুভড বা ‘মাতে নাই’ পরিস্থিতিÑ এটাতেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ইউক্রেন ইস্যুতে বাইডেন হেরে গেলেন। আর এতে প্রথম ধাক্কাটা হলো বাইডেন ইউরোপকে সাথে ধরে রাখতে ফেল করলেন।
অবরোধের স্ববিরোধ
কেন এমন হলো, বাইডেন ইউরোপে কেন হারলেন? এর সোজা জবাব হলো, বাইডেন তার চাপ দেওয়ার ক্ষমতা বাড়াবাড়িভাবে ব্যবহার করেছেন। কী সেটি? বাইডেন-ই এই ইউক্রেনের যুদ্ধকে অবরোধ আর মানবাধিকার এ দুই অস্ত্র দিয়ে লড়বার একক পরিকল্পক। তিনি নিজে রাশিয়ার ওপর এক গাদা সিরিজ অবরোধ আরোপ তো করেছেনই। সাথে ইউরোপকেও চাপ দিয়ে বাধ্য করেছেন একইভাবে অবরোধ দিতে। তাতে এবারই প্রথম ইউরোপ কোনো দেশের ওপর এমন বেপরোয়া হয়ে রেকর্ড পরিমাণ অগুণতি অবরোধ আরোপ করেছে। এ ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে অবিবেচক ও আত্মঘাতী কাজটাও তারা করে ফেলেছে, জাস্ট বাইডেনকে খুশি করতে হবে এই বিবেচনায়। যেন না জানি, তাদের দ্বিধাদ্ব›দ্ব দেখে না আবার বাইডেন মহাশয় ইউরোপের ওপর অসন্তুষ্ট ও ‘সংহতিতে’ নেই মনে করেন কি নাÑ যেন এই ছিল ইউরোপের ভয়। কিন্তু ইউরোপেরও কপাল খারাপ, যেখানে বাঘের ভয় ঠিক সেখানেই যেন গাড়ি খারাপ হওয়ার দশা!
বাইডেনের চাপে তারা খেয়ালই করেননি যে, রাশিয়ার ওপর দিয়ে তাদের ইউরো মুদ্রার অবরোধের অর্থ আসলে কার্যত ইউরোপের নিজের ওপরই অবরোধ দেয়া হয়েছে। কেন?
এটা শুনতে অনেকের মজা লাগতে পারে যে, ইউরো মুদ্রা এখন মহা ক্ষমতাধর হয়ে গেছে যে, সে রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করে তাকে কুপোকাত করে দিতে পারে। তাহলে নিশ্চয় ইউরোপের অর্থনীতি অনেক ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে! তাই কি? একটু দাঁড়ান, ধীরে চলেন প্লিজ! কেন?
ইউরো অবরোধের সোজা মানে হলো, আপনি রাশিয়া এখন থেকে আর আমার ইউরো মুদ্রায় কোনো পণ্য আর বেচা এবং কেনা কোনোটাই করতে পারবেন না। অর্থাৎ ইউরো যাদের মুদ্রা এই ইউরো জোনের বাইরের রাশিয়াসহ সব দেশ তো বটেই এমনকি জোনের ভিতরের সদস্য যেমন জার্মানি সেও রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরোতে গ্যাস কিনতে পারবে না। যেখানে জার্মান অর্থনীতি (চাহিদা ওঠানামা আছে বলে), ৪০-৫৫% রাশিয়ান গ্যাসের ওপর জার্মানি নির্ভরশীল। অর্থাৎ জার্মানিও রাশিয়ান গ্যাস আমদানি করতে পারবে না। কেন?
অবরোধের শুরুতে একটা ফাঁকি দিয়েছিল জার্মানির মতো ইউরোপ। তারা কার্যত রাশিয়ান গ্যাস কেনার ওপর অবরোধ অকার্যকর করে রেখেছিল। ভেবেছিল, এভাবে রাশিয়ার ওপর ইউরো অবরোধ দিয়েও এভাবে রাশিয়ান গ্যাস তারা কিনে-চলতে পারবে। কিন্তু না!
খোদ পুতিন এতে পানি ঢেলে দিয়েছেন। পুতিন ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, যারা আর বন্ধুসুলভ দেশ নয় (মানে যারা রাশিয়ার ওপর অবরোধ দিয়েছে) তারা এখন থেকে রাশিয়ান কোনো কিছু কিনতে চাইলে রাশিয়ার নিজের মুদ্রা রুবলে এর মূল্য পরিশোধ করবে। আর এতেই মহাবিপদে পড়ে গেছে ইউরোপ; বিশেষত যারা রাশিয়ান গ্যাসের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। তাৎক্ষণিক জ্বালানি রেশনিং শুরু করতে হয়েছে তাদের। কারণ ইউরোপে বসবাসে নিজ বাস করার ঘর গরম রাখার কোনো ব্যবস্থা না থাকলে সেই ইউরোপ বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায়। আপনি গরিব-ধনী যাই হন। আর এই সমস্যা মোকাবেলার সবচেয়ে প্রচলিত উপায় হলো, বিপুল জ্বালানি ব্যবহার করে মিউনিসিপালিটির গরম পানির প্রবাহ। প্রত্যেকটা বাসার প্রত্যেক বসবাসের রুমের ভিতরের দেয়াল বেষ্টন করে থাকে এই গরম পানির লাইন। আর তাতেই রুম বসবাসযোগ্য থাকে। তাই গ্যাস ইউরোপের জীবনযাপনে খুবই এসেনশিয়াল। তাহলে এর মানে দাঁড়িয়েছে, যারা রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করে নিজেরা পরাশক্তির ভান ও সুখবোধ করছিল আজ সেই ইউরোপ নিজেরাই নিজেদের অস্ত্রের মুখে কাঁপছেÑ নাকি হয়তো ঠাণ্ডায় কাঁপছে, সব একই কথা হয়ে গেছে! মানে নিজ অবরোধ নিজেরই বিরুদ্ধে চলে গেছে।
অনেকের মনে হতে পারে, রুবলে মূল্য পরিশোধের কথা বলা পুতিনের প্রতিহিংসা। আমেরিকা ইউরোপে প্রপাগান্ডায় পুতিনের যে ছবি এঁকে দিয়েছেন তাতে বেশির ভাগ মানুষ এটাই বিশ্বাস করবে হয়তো। কিন্তু না এটা ফ্যাক্ট নয়। কেন?
ইউরোপ ভাবতে পারে যে, রাশিয়ান গ্যাস কেনাবেচার ওপর তাদের অবরোধ প্রযোজ্য নয়, এই বিশেষ ছাড় দিয়ে তারা তো পুতিনকেই ফেবার করছিল। এই অনুমানটা ভুল। কারণ রাশিয়ান গ্যাসের বিনিময়ে ইউরোপ পুতিনের হাতে ইউরো ধরিয়ে দিচ্ছিল বটে কিন্তু এসব ইউরো অচল। না, এটা অচল পয়সা বা ফেক নোট গছিয়ে দেয়া নয়। আসল ইউরো তারা দিলেও তা রাশিয়ার কাছে অচল নোটের মতোনই ঠেকেছিল। কেন? কারণ রাশিয়া ওই ইউরোতে নিজের কোনো কিছু কেনার বেলায় দাম পরিশোধের মুদ্রা হিসাবে তা ব্যবহার করতে পারে না। মূলত ইউরোপ তো রাশিয়ার ওপর ইউরো ব্যবহার করে কিছু কেনার ক্ষেত্রেও অবরোধ দিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ যেন হাতে একশ টাকার নোট আছে ঠিকই কিন্তু দোকানদার ওই নোট নিতে চাচ্ছে না। সোজা কথায়, রাশিয়ার হাতে পড়লেই ইউরো অচল নোট হয়ে যাবে। তাই ইউরো নিয়ে রাশিয়ার কাউকে গ্যাস বিক্রি করার মানে হলো তাকে মাগনা গ্যাস দেয়া হয়েছে। কারণ রাশিয়ার হাতে থাকা ইউরো বাজারে কেউ নেবে না। এ কারণেই ইউরোপসহ সবাইকে রুবলে দাম শোধ করে পণ্য কিনতে বলাÑ আর এটা পুতিনের কোনো প্রতিহিংসা নয়। এটা আসলে ইউরোপের ইউরো অবরোধের-ই স্ববিরোধিতা। তারা খেয়ালই করেনি যে, রাশিয়ান গ্যাস বিক্রির ওপর অবরোধ আরোপে ছাড় থাকলেও তাতে রাশিয়ার কোনো লাভই নেই; কারণ তা রাশিয়ার যেকোনো কেনাবেচার ওপরেও কোনো ছাড় বলে বিবেচিত হবে না। হওয়ার সুযোগই নেই।
দৃশ্যপটে ভারতের প্রবেশ
আর এখান থেকেই দৃশ্যপটে ভারতের প্রবেশের সুযোগ খুলে যায়। রাশিয়ার ওপর এখন আমেরিকা, ইউরোপ ছাড়াও আমেরিকান কোয়াড সদস্য (কেবল ভারত ছাড়া) সবারই অবরোধ আরোপিত আছে। রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এক বড় উপায় হলো তার মাটির নিচের সম্পদ বিক্রি করা। কাজেই এই সম্মিলিত অবরোধ রাশিয়ার ওপরে যথেষ্ট ভারী প্রভাব এনেছে। আবার ভারতের জনসংখ্যা ১৩৫ কোটি যার কাছাকাছি একমাত্র চীন। এমন বিশাল জনসংখ্যার দেশে জ্বালানি চাহিদা অনুমেয়। তাই পুতিনও ব্যারেল-প্রতি ৩০ ডলার সমতুল্য ছাড় দেয়াতে ভারত ১৬ বিলিয়ন ব্যারেল তেল কিনে নিয়েছে রাশিয়া থেকে রুবলে। আর এটা স্বভাবতই আরোপিত সব অবরোধকেই ফাঁকি দেয়া। অতএব আমেরিকার চোখে ভারত বেয়াড়া এক দুষ্ট ছেলে হয়ে উঠেছে। তাই আমেরিকা ভারতকে প্রথমে বুঝিয়ে বলা, পরে কড়া কথা আর হালকা হুমকি দিতে দিতে গত এক মাস পার করে ফেলেছে। এখন এরপর আগামী পরশু ওয়াশিংটনে বসছে দু’পক্ষের এক ক্রুশিয়াল বৈঠকে।
এমনিতে বাইডেনের দুই অস্ত্রÑ অবরোধ আর মানবাধিকারের কথা যদি বলি তবে শুরু থেকেই বাইডেনের মানবাধিকারÑ এই অস্ত্র তাক করা ছিল মূলত ভারতের দিকে। না ভারতকে ঠিক কোনো বিশেষভাবে ঘায়েল করার জন্য নয়। বরং বাইডেনের দেখানো দরকার এই অস্ত্র তিনি সবার উপরে সমান প্রয়োগ করছেন কোনো বৈষম্য বা কাউকে খাতির ছাড়া। এ ছাড়া এটা বাইডেনের নির্বাচনী ওয়াদা ছিল। বরং ভারতের পাওনা তিনটা অবরোধের সিদ্ধান্ত তৈরি আছে; কিন্তু তিনি কার্যকর না করে ফেলে রেখেছেন। অর্থাৎ বাইডেনের ক্ষমতা নেয়ার পর থেকেই বাইডেন-ভারত এক লাইনে অ্যালাইন করে আর নাই, চলছে না এবং এটাই তাদের ফান্ডামেন্টাল বিরোধ। মানে কেউ কাউকে ছাড় দিয়ে চলতে পারবেন না। কেন?
যে শাসক নরেন্দ্র মোদি নিজেরই এক জনগোষ্ঠীÑ মুসলমানদের খুন করার প্রকাশ্যে আহŸান চলার ব্যবস্থা করে দিতে দ্বিধাগ্রস্ত ননÑ এই মোদিকে চিনতে হবে। কেন মোদি এমন ডেস্পারেট? তার খোঁজ নিলে দেখব, এটাই তার নির্বাচনে জিতে আসার কৌশল। সব পথ হারিয়ে এটাই এখন মোদির একমাত্র অবলম্বন। কাজেই মুসলমান নিগৃহীত করা তার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। তবেই জোশে হিন্দু ভোট তার বাক্সে আসবে। অতএব, এ জায়গায় বাইডেনের মানবাধিকারের কথায় কোনো ছাড় দিতে পারবেন না। আবার বাইডেনও ভারতকে মানবাধিকারে এমন জলজ্যান্ত লঙ্ঘন উপেক্ষা করতে পারবেন না। কারণ অবরোধ ও মানবাধিকার এ দুই এখন তার প্রধান অস্ত্র। তিনি এই অস্ত্র প্রয়োগ বাতিল না করে বড়জোর পিছিয়ে যত দিন দেরি করা যায় তা করতে পারেন, এটাই কেবল বাইডেনের হাতে আছে। তাই এটা হলো বাইডেন-ভারত সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা না হওয়ার পথে প্রধান এক বাধা
বাধা দুই
রাশিয়ার ওপরে ভারতের সমরাস্ত্রে নির্ভরশীলতা, সেটি কমপক্ষে ৭০ শতাংশ। সম্প্রতি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার এক রিপোর্ট এটাকে ৮৫% বলেছে। তাই আমেরিকার রাশিয়ান অবরোধ আরোপের পরে সবচেয়ে বড় বিপদ গুনেছে ভারত। প্রধান কারণ সত্যিই ভারতের সাথে কোথাও সাত দিন যুদ্ধ চললে এরপর ভারত রাশিয়ান সাপ্লাই বিশেষত ছোট-বড় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও স্পেয়ার্স পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যাবে, এ জন্য। এমন অবস্থার পেছনের কারণ দু’টি। এক. রাশিয়ান অস্ত্র তুলনায় আমেরিকান যেকোনো অস্ত্রের চেয়ে সত্যিই দশগুণ সস্তা। একটা হেলিকপ্টার, এমন ন্যূনতম ভারী অস্ত্রের বেলাতেই এটা সত্য। দুই. রাশিয়া আসলে ভারতের কোল্ডওয়ার-কালের মিত্র। ফলে রাশিয়ান অস্ত্রনির্ভর হয়েই সেকালে ভারত নিজের প্রতিরক্ষা সাজিয়েছিল। সুবিধা ছিল প্রধান শত্রæ পাকিস্তান যেমন আমেরিকার সাথে গাঁটছাড়া বাঁধা। ফলে ভারতেরও রাশিয়ার সাথে বাধা পড়লে এটা দীর্ঘ দিন একই সাপ্লায়ার হয়ে টিকে থাকার বা কাজ করার সম্ভাবনা। তাই এই নির্ভরশীলতার সম্পর্ক জেনেশুনেই তৈরি করা হয়েছিল। তবে এটাতে নড়াচড়া পড়েছিল ২০০১ সালে বুশের আমলে ওয়ার অন টেরর ইস্যুতে ভারত মিত্র হওয়ার পর থেকে। অর্থাৎ কোল্ডওয়ারÑউত্তরকালে সেই প্রথম বুশ ভারতকে নিষিদ্ধ পারমাণবিক কাঁচামাল ও টেক সরবরাহের লোভ দেখানোতে। সেখান থেকেই ক্রমেই এটা ২০০৬ সালে বুশের ভারত সফর হয়ে পরে চীন ঠেকানোর নাম করে ভারত-আমেরিকা সখ্যের গভীরতা শুরু। আর এতেই ভারতের এখন সবচেয়ে করুণ দশায়। বলা হচ্ছে ‘বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর সবচেয়ে চিকন এক দড়ির উপর দিয়ে হাঁটছেন।’ কেন এমন মনে করা?
একেবারে প্রধান শঙ্কা হলো, রাশিয়ান অস্ত্রের সাপ্লাই; কারণ রাশিয়ার ওপর বলতে গেলে আমেরিকার সব বন্ধু অবরোধ আরোপ করেছে। তাহলে ভারত রাশিয়ান স্পেয়ার্সের সাপ্লাই পাবে কী করে? অর্থ পরিশোধ করবে কী উপায়ে? আর এখান থেকেই আমেরিকান অবরোধ বাইপাস করে রুবলে রাশিয়ার সাথে পণ্য লেনদেনের ব্যবস্থা প্রথম চালু করে ভারত। স্বভাবতই এটাই বাইডেনের সবচেয়ে বড় না পছন্দ। এসব নিয়েই রিপোর্টে ভারতের মিডিয়া তোলপাড়। যদিও ইউক্রেন ইস্যু হাজির হবার আগে থেকেই ভারত বাইডেনের বিকল্প বা বাইডেনের ওপর পাল্টা চাপ তৈরির চেষ্টা করে আসছিল, যাতে মুসলমান দলনের কারণে মোদির ওপর আমেরিকান মানবাধিকার চাপ ভারত এড়াতে পারে। কিন্তু রাশিয়ার ‘কোলে চলে যাওয়া’র তখন যে ভানটা ভারত তৈরি করেছিল সেটিই এখন একেবারেই সিরিয়াস হয়ে গেছে।
অবস্থা দেখে মনে হয় ভারতের মনের গহিনের অনুভব সম্ভবত এটাই যে, ভারত আমেরিকার সাথে সখ্য চাইলেও শেষে ভারত তা রক্ষা করতে পারবে না। রশিয়ার কাছে যেতেই হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে চীনের সাথে সম্পর্কটা কেমন হবেÑ এই হলো ভারতের দ্বিধা অস্পষ্টতার জায়গা। ফলে আমেরিকা চাপ দিলেই ভারত দিশেহারা বোধ করে। আর নিজ বিপুল জনসংখ্যার বাজারের লোভ দেখিয়ে সব ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু এবার স্টেক সম্ভবত অনেক উঁচু! তাই কী হবে এই আশঙ্কা জয়শঙ্করেরও!
এসবের মধ্যেই ব্যাপক ক‚টনৈতিক দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়েছে। ভারতের এই রুবলে দেনদেন চালুর ব্যাপারে এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর হতে চান বাইডেন। সর্বশেষ এটা নিয়েই মূলত ওয়াশিংটনে দু’দিন পরে ভারত-আমেরিকান বৈঠক, যার গালভরা নাম ‘২+২’। আর এখানেই রাশিয়ান এস-৪০০ কেনার শাস্তি হিসাবেও এক অবরোধ আরোপ পেন্ডিং পড়ে আছে। আর এখানে ২+২-এর মানে হলো, দু’দেশেরই দুই পররাষ্ট্র ও দুই প্রতিরক্ষামন্ত্রীর একসাথে চারজনের বৈঠক। এর আগে চীনকে দেখাতে যে, ভারত যেন পরাশক্তি হয়ে গেছেÑ তা ভেবে এমন ২+২ বৈঠক নিয়ে মিডিয়ায় গর্ব ভরে উপচে উঠত আমরা দেখেছি। কিন্তু আর আজ সেসব ¤øান, সবাই রিয়েল প্রবলেমের সামনে পড়েছে। তাই যেন ভ্যানিটি উপাদানগুলো অনাদরে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
তবে এটাও ভুলে যাওয়া ভুল হবে যে, জয়শঙ্করের ‘খুব চিন্তায় আছি’ টাইপের ইমেজটা তৈরি করেছেন এর আরেক অর্থ ও উদ্দেশ্য আছে। তা হলো, ভারতের কেনাকাটার ওপর এসব আমেরিকান অবরোধে যেন সে ছাড় পায় সে জন্য আমেরিকার সামনে এক করুণ ইমেজ তৈরি করা। যদিও ভারত জানে, বাইডেনের এখানে ছাড় দেয়ার সুযোগ বা ইচ্ছা নেই। তবে জয়শঙ্করের আসল উদ্দেশ্য হলো ভারতে মোদির মুসলমান কোপানোতে এর ওপর কোনো মানবাধিকারের অবরোধ যেন আরোপিত না হয়।
তবে ভারতের দিক থেকে আরেক রিয়েল থ্রেটও আছে যেটা ভারতের ভাষায় চীনের সাথে তার সীমান্তবিরোধ। যেটা আর কিছুই না, কলোনি আমল থেকেই অচিহ্নিত হয়ে থাকা সীমানা। যদিও এ কথা মনে করার কারণ আছে, এটা মূলত উগ্র হিন্দুত্ব এমন জাতিবাদী কল্পনার শাসক মোদি হওয়ার কারণে। যে কারণে এই যে দেখার বা উপস্থাপনের চেষ্টা যে, মোদির হিন্দুত্ব জাতিবাদ সীমান্ত রক্ষায় সবচেয়ে দেশপ্রেমিক! কিন্তু আসলেই কি এই প্রদর্শন খুবই মূল্যবান? সীমান্ত দুই ইঞ্চি জায়গা ছাড় বা দখল পাওয়াটাকে হিন্দুত্বের জাতিবাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরে ভোটের বাক্সে এর ফল ক্যাশ করার চেষ্টাÑ এই ফালতু জাতিবাদের আছে।
বরং ভারতের লম্বা ও দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক স্বার্থের দিকে চেয়ে কথা বললে এই কথিত সীমান্তবিরোধ হতো তুলনায় তুচ্ছ। আর আমেরিকা যদি ক্রমেই হেরে যাওয়া গেøাবাল নেতা হয়ে থাকে আর চীন যদি সে জায়গা নিতে ক্রমেই উত্থিত নেতা হতে থাকে তাহলে বুড়া সিংহ আমেরিকার যে ন্যাচারালি মরণ হবে। কারণ এর আর ভারতকে ন্যূনতম বিনিয়োগ বা ঋণ দেয়ার মুরোদও নেই। তাই প্রতীকী অর্থে ক’দিন পরে মরবেÑ এর সাথে ভারতের গাঁটছড়া বাঁধার অর্থ কী? ভারতের বন্ধু তো হওয়ার কথা ভারতের আগামীরা, তার অতীত নয়। এটা মানতে না পারার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা আসলে মোদির উগ্র হিন্দুত্ব, এই চোখ দিয়ে দেখার সমস্যা।
ভারত-আমেরিকান নড়বড়ে সম্পর্ক
ইউক্রেনে হার হচ্ছে টের পাওয়ার পরে বাইডেন দক্ষিণ এশিয়ায় জোর দিয়েছেন, মনোযোগ ফোকাস করেছেন। এটা ভারতও সেন্স করেছে। যেমন এক মিডিয়া রিপোর্ট তাই লিখছে, ‘পাকিস্তানের অস্থিরতা, কলম্বোর অর্থনৈতিক ক্রাইসিস, মালদ্বীপে ভারতবিরোধী ক্যাম্পেইন, তালেবানদের ভারতবিরোধিতা ও চীনের প্রভাব বাড়ানোতে ভারতের প্রতিবেশী দেশের অস্থিরতা ভারতের জন্য লংটার্ম রিস্কের ইঙ্গিত।’ অথচ আগে হলে মানে, ভারত আমেরিকার শক্ত কোয়াড বন্ধু হয়ে থাকার কালে এসব অস্থিরতাকে ভারত ইতিবাচকভাবে দেখত, নিজের প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে নিত। অথচ এখন শঙ্কিত হচ্ছে। আসলে ভারত যদি নিজেকে চীনের সাথে তুলনীয়ই শুধু না, এক পরাশক্তি ভাবতে থাকে তাহলে আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক আর ঘনিষ্ঠ না থাকলে চীনের সামনে সেই ভারতের কী হবে এ নিয়ে হাত পা কাঁপাকাঁপি করা থেকেই এমন রিপোর্টই তো লেখা হবে এবং হয়েছেও।
যা হোক, ভারতের মন এখন আশঙ্কায় পূর্ণ যে আমেরিকা-ভারত সম্পর্কটা কি একেবারে ভেঙে না গেলেও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে? যেমন রাশিয়ার সাথে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে আমেরিকান আপত্তি যদি ভারত না শুনে তবে খোদ ভারতের ওপরই একটা অবরোধ আরোপ হতে পারে আর সেটি খুব দূরের কিছু নয়। আর এটা নিয়েই আসলে ভারতের মূল দুশ্চিন্তা। আর সে ক্ষেত্রে তাহলে এশিয়ায় সুনির্দিষ্ট করে বললে, বাংলাদেশে কী হবে?
বাংলাদেশে কোনো হবু আমেরিকান তৎপরতা বা হস্তক্ষেপে ভারত কোথায় কোন দিকে অবস্থান নেবে, থাকবে, তাহলে সে ক্ষেত্রে? একটা সম্ভাবনা ধরা যাক যদি আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক খুবই নিচে চলে গেল; তবু সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেলায় ব্যতিক্রমভাবে তারা একসাথে এমন দেখতে পাওয়া অসম্ভব নয়। যদিও এমনটা দেখতে পাবার সম্ভাবনা কম। আবার অন্য একটা কথাও আছে।
বাংলাদেশে কোনো তৎপরতায় আমরা যদি আমেরিকাকে দেখি, যার বগলে ভারত বাঁধা আছে তবে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বা যেমন ধরা যাক যাদেরকে অনেকে ‘ইসলামিস্ট’ বলে, এদের প্রতিক্রিয়া খুবই খারাপ হবে। এদের কাছে আমেরিকার কোনো গ্রহণযোগ্যতা দূরে থাক সে ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হবে। তাতে ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক যেমন অবস্থাতেই থাকুক না কেন। বলা যায়, এটাই গত ১৪-১৫ বছরে বাংলাদেশে ভারতের অর্জন! হ
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com