আবু সাইদ বিশ্বাস একদিকে নিশ্চিত দাম বাড়া, অন্যদিকে অনিশ্চিত আয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবন এখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। দ্র্রব্যের মূল্য আগের তুলনায় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষেতের ধান বিক্রি করে ঈদ কেনা কাটায় খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। গ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকা অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বেঁচে থাকার সংগ্রামে, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এখন তাদের কাছে মুখ্য। গ্রামে খাদ্যপণ্যের চাহিদাই বেড়েছে। খাদ্যবহির্ভূত অন্যান্য পণ্যের চাহিদা কমেছে। একই সঙ্গে গ্রামের খাদ্যের সরবরাহ বেশি হওয়ার কথা, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের সরবরাহ কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা উলটো। গ্রামে সার্বিকভাবে খাদ্যের সরবরাহ বেশি হলে মজুতদারদের কারসাজির কারণে দাম বেশি। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের জোগান স্বাভাবিক থাকলেও ব্যয়সাপেক্ষ। যে কারণে গ্রামে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। গত বছরের এপ্রিলের তুলনায় এবারের এপ্রির্লে শহরে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। কিন্তু গ্রামে এ হার ৬ দশমকি ৭১ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে ১ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে একই সময়ে শহরে এ হার ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। কিন্তু গ্রামে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে এ হার দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতির হার এখন ৫.৮ শতাংশ। কিন্তু নিত্যপণ্যের বেপরোয়া মূল্যবৃদ্ধি বাস্তবে মূল্যস্ফীতির এই হিসাবের তুলনায় গ্রামে বহুগুণ বেশি।
সাধারণত শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে শহরের চেয়ে গ্রামেই মূল্যস্ফীতির হার বেশি। গত ১৪ মাস ধরেই শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। এতে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় শহরের চেয়ে অধিক হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ চাল উতৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, যা বিশ্বের মোট উৎ্পাদনের ৭ শতাংশ। দেশের জনগণের দৈনিক ক্যালরির ৭০ শতাংশের বেশি আসে গ্রামের এই চাল থেকে। কয়েক দশকে চাল উৎপাদন তিন গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তার পরও চালের দাম বাড়তি। খাদ্যপণ্যের, বিশেষ করে প্রধান খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যস্ফীতি দেশের স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।
বিশেজ্ঞরা বলছে,বেশির ভাগ পণ্যই শহর থেকে যাচ্ছে গ্রামে। কৃষিভিত্তিক নিত্যপণ্যের উৎপাদন গ্রামে হলেও মজুদ গড়ে উঠছে শহরে। উৎপাদনের পরপরই সেগুলোর বেশির ভাগই কৃষকের হাত থেকে চলে যাচ্ছে জমুতদারদের নিয়ন্ত্রণে। তারা কম দামে কিনে বেশি দামে গ্রামের মানুষের কাছে বিক্রি করছে। এতে পরে নিজের উৎপাদিত পণ্যই বাড়তি দামে কিনছে কৃষক। এসব কারণেই মূল্যস্ফীতির হার গ্রামে অধিক হারে বাড়ছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্সের অর্ধেকের বেশি যাচ্ছে গ্রামে। এগুলোর ৫৩ শতাংশই ভোগ বিলাসে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে অনুৎপাদনশীল খাতে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। মূলত এ দুটি কারণেই গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যায়, গত মার্চে শহরে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ। গ্রামের হয়েছে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হয়েছে দশমিক ৮৩ শতাংশ। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত টানা ১৪ মাস শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হয়েছে।
গবেষকদের মতে, গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম থাকার কথা। ওই সময়ে গ্রামে ধানসহ শাকসবজির উৎপাদন বেশি হয়। এগুলোর সরবরাহও কম থাকে। এ হিসাবে মূল্যস্ফীতির হারও কমার কথা। কিন্তু তা সার্বিকভাবে কমে না। তখনও শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি থাকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত অর্থবছরের জুলাই ফেব্রুয়ারির তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে শহরের চেয়ে গ্রামে অর্থের প্রবাহ বেড়েছে। এর মধ্যে মোট আমানতের ৭৯ শতাংশ শহর থেকে ও ২২ শতাংশ গ্রাম থেকে আসছে। মোট ঋণের ৯১ শতাংশ দেওয়া হয় শহরে ও গ্রামে ৯ শতাংশ। বিশেষ করে ঋণের একটি অংশ যাচ্ছে গ্রামে। এছাড়া কৃষি, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত ও রেমিট্যান্স প্রবাহ গ্রামেই যাচ্ছে বেশি। এসব অর্থের একটি বড় অংশই অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে যা মূল্যস্ফীতির হারকে উস্কে দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে আগে শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম ছিল। গত কয়েক বছর ধরে হঠাৎ করেই গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার অধিক হারে বাড়ছে। এর একটি কারণ হতে পারে-নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে সরকার শহরে ভর্তুকি দিয়ে খাদ্য বিতরণ করছে। গ্রামে সেটি শহরের মতো ব্যাপক হারে করছে না। গ্রামে উৎপাদিত পণ্যের একটি বড় অংশই চলে যাচ্ছে মজুতদারদের দখলে। তারা সময়মতো বাড়তি দামেই পণ্য বিক্রি করছেন। গ্রামে পণ্য উৎপাদন হলেও ভোক্তারা কম দামে পণ্য পাচ্ছেন না।
বিবিএসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, মানুষের জীবনযাত্রায় খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মধ্যে কাপড়, জুতা, পরিবহণ, বিনোদন ও বিবিধ খাতে শহরের চেয়ে গ্রামে ব্যয় বেশি বেড়েছে। গত বছরের মার্চে তুলনায় এ বছরের মার্চে কাপড় ও জুতার দাম গ্রামে বেড়েছে দশমিক ৬২ শতাংশ, শহরে বেড়েছে দশমিক ৪৬ শতাংশ। গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি বেড়েছে দশমিক ১৬ শতাংশ। একই সময়ের ব্যবধানে গ্রামে পরিবহণ খাতে ব্যয় বেড়েছে দশমিক ৩২ শতাংশ, শহরে বেড়েছে দশমিক ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি বেড়েছে দশমিক ১৫ শতাংশ। বিনোদন খাতে একই সময়ে গ্রামে ব্যয় বেড়েছে দশমিক ৭৮ শতাংশ, শহরে বিনোদনের সঙ্গে শিক্ষা যুক্ত করে ব্যয় বেড়েছে দশমিক ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি বেড়েছে দশমিক ৪৬ শতাংশ। বিবিধ খাতে গ্রামে ব্যয় বেড়েছে দেড় শতাংশ, শহরে বেড়েছে দশমকি ৭১ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে শহরের চেয়ে গ্রামে ব্যয় বেশি বেড়েছে ৭৯ শতাংশ।
এছাড়া চিকিৎসা খাতে চরম হয়রানি, প্রতরণা ও ভূল চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হয় গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষরা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর সর্বশেষ রিপোর্টে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে তো সংকট আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। অভাব আর দারিদ্র্যের কশাঘাতে আজকের জনজীবন দুঃখ ও হাহাকারে পূর্ণ। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি দ্রব্যের মূল্য আগের তুলনায় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে
খাদিজা, এক ছেলে ও এক মেয়ের জন্য ঈদ কেনা কাটা করতে সাতক্ষীরার এক জুতার দোকানে যান। ৪ বছরের মেয়ের জন্য জুতা কিনতে যেয়ে জুতার দাম শুনে চোখ কপালে উঠে যায়। তিনি জানান, দুই বছর আগে যে জুতার দান ছিল ৩শ থেকে ৫শ টাকার মধ্যে এবারের ঈদে সেই জুতার দাম ৯৯০ টাকা। যে খানে জেলাতে একটি ছাগলের চামড়ার দাম বিক্রি হয় ১০ টাকায় আর একটি বড় গরুর চামড়া বিক্রি হয় ২শ থেকে ৩শ টাকায়। সেখানে সামান্য চামড়া দিয়ে তৈরি জুতার দাম এত হয় কি করে। বিশাল এই বৈষম্য গ্রামের মানুষ গুলোকে নিঃস্ব করে ফেলেছে। তিনি জানান, এত দাম বেশি দেখে ছেলে মেয়ের জন্য কিছু কিনলাম। আমার জন্য কিনতে পারলাম না। ছেলে মেয়েদের বললাম আমি পরের ঈদে নেব। জানি না পরের ঈদ আর আমার কপালে আসবে কি না।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে দেশের সাধারণ মানুষের আরো একটু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রদানে সরকারকে যথেষ্ট ভূমিকা রাখার দাবী জানিয়েছে গ্রামের মানুষরা।
আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: ৩০/৪/২০২২
০১৭১২৩৩৩২৯৯
Check Also
আশাশুনি উপজেলা জামায়াতের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন
এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আশাশুনি উপজেলা শাখার ২০২৫-২০২৬ সেশনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন ও …