অর্থনীতিতে উৎপাদন কাজে পরিশ্রমের বিনিময়ে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যকে ব্যবহারের নাম শ্রম। মানব সভ্যতার শুরু থেকেই একশ্রেণির মানুষ অন্যের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এরাই শ্রমিক। যাদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্র নেই। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে বেশিরভাগ সময়ই মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক ছিলো ‘বন্ধুর’ তথা জটিল ও কুটিল। সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করলেও সবার সামাজিক অবস্থান একই রকম নয়। অধিকার প্রতিষ্ঠা দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের সু-সম্পর্ক ও সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। পারস্পরিক সমঝোতা ছাড়া কোনোক্রমেই তা সম্ভব নয়। এ জন্য মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক রক্ষা করার ব্যাপারে আল-কুরআন তথা ইসলামে জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্র, সমাজ ও জাতির সার্বিক উন্নতি-অগ্রগতির জন্য শ্রম এক অপরিহার্য উপাদান। অর্থনীতিতে উৎপাদন কাজে পরিশ্রমের বিনিময়ে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যকে ব্যবহারের নাম শ্রম। শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনকারী ব্যক্তি শ্রমিক। উন্নয়নের জন্য শ্রমের বিকল্প নেই। তাই শুধু মসজিদে বন্দেগিতে মশগুল না থেকে সালাত শেষে জীবিকার্জনের জন্য পৃথিবীতে বের হয়ে পড়ার কথা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ‘অতঃপর যখন সালাত (আদায়) শেষ হয়ে যায়, তখান তোমরা জীবিকা অন্বেষণের জন্য জমিনে ছড়িয়ে পড়।’ (আল কুরআন; ৬২ : ১০)।
এ কথা সত্য যে, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় মালিকের সম্পত্তিতে অধিকার নেই শ্রমিকের। এ ব্যবস্থায় ধনীরা আরো ধনী, গরিব আরো গরিব হয়। শ্রমিকের সাথে মালিক ততটুকুই সম্পর্ক রাখে যতটুকু তার স্বার্থের জন্য দরকার। অন্য দিকে সমাজতান্ত্রিক সমাজে সম্পত্তির মালিক রাষ্ট্র। কিন্তু সেই সম্পত্তির সুষম ও ইনসাফভিত্তিক বণ্টন না হওয়ায় ক্রমেই বন্ধ হয় ব্যক্তি উদ্যোগ। আর বণ্টন ব্যবস্থায় অদক্ষতার কুফল ভোগ করে মূলত শ্রমিক ও গরিব শ্রেণী।
মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক হবে বাবা-সন্তানের মতো। নিজের পরম আত্মীয়ের মতো শ্রমিকের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ করা, পরিবারের সদস্যের মতোই তাদের আপ্যায়ন করা, শ্রমিকের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রতিটি মুহূর্তের প্রতি মালিকের খেয়াল রাখা এবং তাদের সুযোগ-সুবিধার প্রতি লক্ষ রাখা মালিকের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। শ্রমিকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সামান্য মজুরি দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিতকারীদের ব্যাপারে রাসূল সা: বলেন, ‘তাদের ব্যাপারে কিয়ামতের দিন অভিযোগ করা হবে। শ্রমিকের কাজে ফাঁকি দেয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এ জন্য তাকেও কিয়ামতের দিন জবাবদিহি করতে হবে। আর শ্রমিক যদি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে তার জন্য দ্বিগুণ পুরস্কারের ঘোষণায় রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘ওই শ্রমিক যে নিজের মালিকের হক আদায় করে সে আল্লাহর হকও আদায় করে’ (মিশকাত শরিফ : হা/১১)। হযরত আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা: বলেন, যেই সত্তার হাতে আমার প্রাণ সেই সত্তার কসম! যদি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ, হজ ও আমার মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহারের ব্যাপারগুলো না থাকত, তাহলে আমি শ্রমিক হিসেবেই মৃত্যুবরণ করতে পছন্দ করতাম’ (বুখারি শরিফ : হা/২৫৮৪)।
পৃথিবীতে যা কিছু গড়ে উঠেছে তা সবই শ্রমের ফল। দুনিয়ার সকল নবি, সকল রাসুল ও আল্লাহভীরু সকল মানুষ নিজ শ্রমের আহার ভক্ষণ করেছেন। হজরত আদম আ. ছিলেন দুনিয়ার প্রথম চাষী, হজরত নূহ আ. ছিলেন রাখাল, রাসূল সা: মজুরের বিনিময়ে মক্কার লোকদের ছাগল চরিয়েছেন। পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহকারীকে হাদিসের মধ্যে রাসূল সা: আল্লাহর বন্ধু বলেছেন (বুখারি)। রাসূল সা: শ্রমের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘কারো জন্য নিজ হাতের উপার্জনের চেয়ে উত্তম আহার্য আর নেই।’ আল্লাহর নবী দাউদ আ. নিজ হাতের কামাই খেতেন (মিশকাত-২৭৫৯)।
পৃথিবীতে মনুষ্য জীবরে আবির্ভাবের সময় থেকেই ইসলাম শ্রম ও শ্রমিকের যথার্থ মূল্যায়ন করেছে। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের সময় শ্রমজীবীকে পশুর মতো হাটবাজারে বিক্রি করা হতো। রাসূল সা. সেই সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা সমুন্নত করেছেন। রাসূল সা: সব সময় গরিবের সাথে থাকতেই পছন্দ করতেন। তিনি মনিব-গোলাম প্রথাকে ঘৃণা করতেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি আমার সব আদম সন্তানকেই সম্মানিত করেছি আর কাউকে অন্যের ওপর বেশি মর্যাদা দিয়েছি’ (আল কুরআন; ১৭:৭০)।
ইসলাম সব বৈধ পেশাকে উৎসাহিত করে এবং সব পেশার মানুষকে সমান সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে থাকে। সম্পদ, বংশ ও পেশার কারণে মানুষের মর্যাদা নিরূপিত হয় না। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নিরূপিত হয় নৈতিকতা, নিষ্ঠা ও তাকওয়ার ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সেই সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি যিনি তাকওয়াবান তথা মুত্তাকী।’ (আল কুরআন; ৪৯:১৩)।
শ্রমিকের অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করতে ইসলাম মূলনীতি ও বিধান প্রবর্তন করেছে। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘সর্বোত্তম উপার্জন হচ্ছে মজুরের (কায়িক শ্রমের) উপার্জন, যদি সে মনিবের সদিচ্ছা ও ঐকান্তিকতার সাথে সম্পন্ন করে’ (মুসনাদে আহমদ)।
শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে বিশ্বনবী স.-ই সর্বপ্রথম মানবিক শ্রমের নীতি ও আইন প্রনয়ন করেন। ইসলাম মালিকের কাঁধে যেসব বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শ্রমের মূল্য বা মজুরি। পবিত্র কুরআনে কমপক্ষে দেড় শ’ স্থানে ‘আজর’ তথা শ্রমের মূল্য বা বিনিময় শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে।
রাসূল স. পারিশ্রমিক নির্ধারণ ছাড়া শ্রমিক নির্বাচন করে শ্রমিকের কাছ থেকে কাজ আদায় করতে নিষেধ করেছেন। কাজের আগে মালিক-শ্রমিকের সাথে চুক্তি করে, সেই চুক্তির আওতায় শ্রমিক কাজ করে, বিনিময়ে মালিক তাকে মজুরি দেয়। এখানে মালিক ও শ্রমিক পরিপূর্ণভাবে চুক্তি বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকবে। শ্রমিক নিজের ওপর মালিকের দায়িত্ব নিয়ে এমন এক নৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যে, এ কাজ সে অর্থ উপার্জনের জন্য করে না, বরং এর সাথে পরকালের সফলতা জড়িত বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। চুক্তি পূর্ণ করার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করো। নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে’ (আল কুরআন; ২৮ : ২১৬, ৫ : ১)। শ্রমিকের দায়িত্ব চুক্তি মোতাবেক মালিকের প্রদত্ত কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদনা করা। রাসূল সা: বলেন ‘ধনী ব্যক্তির পক্ষ থেকে কারো পাওনা প্রদানে টালবাহানা করা জুলুম, আর যখন তোমাদেরকে কোনো সক্ষম ব্যক্তির প্রতি ন্যস্ত করা হয় তখন সে যেন তা অনুসরণ করে’ (বুখারি : হা/২২৮৭)। অন্য হাদিসে এসেছে- মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির বিপক্ষে থাকব তার মধ্যে একজন হচ্ছে ওই ব্যক্তি যে কাউকে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করার পর তার থেকে কাজ বুঝিয়ে নিয়েছে অথচ তার প্রাপ্য দেয়নি’ (বুখারি : হা/২২২৭)।
হজরত আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূল সা: বলেন, ‘তোমাদের অধীনস্থ ব্যক্তিরা দাস-দাসী, শ্রমিক, কর্মচারীরা তোমাদের ভাই। সুতরাং আল্লাহ যে ভাইকে যে ভাইয়ের অধীন করে দিয়েছেন সে তার (শ্রমিকের) ভাইকে যেন তাই খাওয়ান যা সে নিজে আহার করেন, আর তাই পরিধান করান যা সে নিজে পরিধান করেন’ (আবু দাউদ ২/৩৩৭)। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। অতএব ভাইয়ের সাথে সর্বদাই সদ্ভাব স্থাপন করবে’ (আল কুরআন; ৪৯:১০)। মালিক-শ্রমিক কর্মচারীদের এমন সব আচরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে যা দ্বারা সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে। এমন ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক একটি সুস্থ ও সভ্যসমাজ ব্যবস্থার পূর্বশর্ত।
ইসলামের আলোকে শ্রমনীতি হলো-
ক. মালিক-শ্রমিক পরস্পরকে ভাই ভাই মনে করবে।
খ. মৌলিক মানবিক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শ্রমিক ও মালিক উভয়ের মান সমান হবে।
গ. কাজে নিযুক্তির আগে শ্রমিকদের সাথে যথারীতি চুক্তি হবে এবং তা যথাসময়ে পালিত হবে।
ঘ. শ্রমিকের অসাধ্য কাজ তার ওপর চাপানো যাবে না।
ঙ. শ্রমিকের স্বাস্থ্য, শক্তি ও সজীবতা বজায় রাখার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যয়ের নিচে মজুরি নির্ধারণ হবে না।
চ. উৎপন্ন দ্রব্যের অংশবিশেষ শ্রমিকদের দান করতে হবে।
ছ. পেশা বা কাজ নির্বাচনের ও মজুরির পরিমাণ বা হার নির্ধারণ সম্পর্কে দর দস্তুর করার পূর্ণ স্বাধীনতা শ্রমিকের থাকবে।
জ. অনিবার্য কারণ বা নিয়ন্ত্রণ ঘটনার বহির্ভূত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কাজে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন না চালানো।
ঝ. মালিকপক্ষ দুর্ঘটনা ও ক্ষয় এড়ানোর সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে।
ঞ. কোনো অবস্থাতেই শ্রমিকদের অসহায় করে ছেড়ে দেয়া যাবে না, অক্ষম ও বৃদ্ধ হয়ে পড়লে উপযুক্ত ভাতার ব্যবস্থা করা।
ট. পেশা পরিবর্তনের অধিকার শ্রমিকের থাকবে।
ঠ. পরিবার গঠনের অধিকার শ্রমিকের থাকবে।
ড. স্বাধীনভাবে ধর্মীয় অনুশাসন পালনের অধিকার শ্রমিকের থাকবে।
ঢ. স্থানান্তর/ গমন/ ছুটি নেয়ার অধিকার শ্রমিকের থাকবে।
ন. শ্রমিকের স্বাস্থ্য সংরক্ষণ ও চিকিৎসার উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে সামাজিক শান্তি ও রাষ্ট্রীয় সমৃদ্ধি তখনি কেবল সম্ভব হবে যখন শ্রমিকের প্রতি ইসলামের উদার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবে রূপায়িত হবে। কারণ, ইসলামে শ্রম যদি হয় ব্যক্তির দায়িত্ব, তবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব প্রতিটি ব্যক্তির জন্য কর্মের সংস্থান করা। ব্যক্তির যদি দায়িত্ব হয় কাজে নিষ্ঠার পরিচয় দেয়া, তবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পদ ও মালিকানায় সুষম বণ্টন করা। ইসলাম মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের যে নীতিমালা দিয়েছে উভয়েই যদি তা অনুসরণ করে তাহলে পৃথিবীতে বঞ্চিতদের আর্তনাদ শোনা যাবে না, শ্রমিক অসন্তোষও দেখা দেবে না। পৃথিবী হয়ে উঠবে একটি শান্তির আবাসস্থল।
লেখক : বিলাল মাহিনী, প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, অভয়নগর, যশোর।
প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর।
আজীবন সদস্য : নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট।