আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: এবারের ঈদে তীব্র খাবার পানির সংকটে পড়েছে সাতক্ষীরা। সিমাই চিনি কেনার সামর্থ থাকলেও সূপেয় পানি সংগ্রহ দায় হয়ে পড়েছে। এক দিকে প্রচন্ড গরম অন্য দিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াতে পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে গোটা জেলাতে। কয়েক মাসে প্রয়োজনীয় বৃষ্টির দেখা না মেলায় ভূউপরিস্থ পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। তীব্র খরা, বৃষ্টিহীনতা ও পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার জনজীবনে হাসফাস উঠেছে। সরকারী হিসেবে জেলার ২৫ হাজার সরকারি টিউব অয়েলে পানি উঠা বন্ধ হয়ে গেছে। সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের খবর অনুযায়ী বর্তমান সময়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সাতশ’ ফুট পর্যন্ত নেমে গেছে। তবে স্থান বিশেষে তা পাঁচশ’ ফুট পর্যন্ত রয়েছে। ছাড়া পারিবারিকভাবে বসানো হাজার হাজার নলকূপেও পানি নেই। এতে পানি সংকটে পড়েছে জেলার প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী পানিতে সর্বোচ্চ ২৬০০ এমজি পার লিটার লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। উপকূলীয় এলাকায় যার গ্রহনযোগ্যতা মাত্র ১০০০ এমজি পার লিটার। ফলে মাত্রারিক্ত লবণাক্ততার ফলে বিভিন্ন কঠিন ও জটিল রোগের সম্মুখিন হচ্ছে এখানকার সাধারণ মানুষ।
জনস্বাস্থ্য বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: শহীদুল ইসলাম জানান, জেলার ২৫ লাখ জনগোষ্ঠীর ৮৫ শতাংশ মানুষের খাবার পানি সরবরাহ করার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। কিন্তু পানির স্তর নেমে যাওয়ায় মানুষ খাবার পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারিভাবে জেলায় ১১৫টি পিএসএফ (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) বসানো রয়েছে। ভূ উপরিস্থ পানি নিয়ে তা শোধনের মাধ্যমে পরিবারগুলিতে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। অথচ ভূ উপরিস্থ এসব পানিও এখন অনেক কমে গেছে। ফলে কোন কোন জায়গায় পিএসএফ যথাযথভাবে কাজ করতে পারছে না। তিনি জানান, বেসরকারি পর্যায়ে সাতক্ষীরার কয়েকটি এনজিও বিভিন্ন স্থানে এসব পিএসএফ বসিয়েছে। সেখানেও দেখা দিয়েছে একই সংকট।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ আরও জানিয়েছে, বৃষ্টি না হওয়ায় পানি যেমন অনেক নিচে নেমে গেছে তেমনি পানিতে লবণাক্ততাও মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী পানিতে সর্বোচ্চ ২৬০০ এমজি পার লিটার লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। উপকূলীয় এলাকায় গ্রহনযোগ্যতা ১০০০ এমজি পার লিটার। তবে দেশের অন্যান্য এলাকায় এই পানির গ্রযোগ্যতা সর্বোচ্চ ৬০০ এমজি পার লিটার। পানিতে অতিমাত্রায় লবণাক্ততার কারনে উপকূলের লোকজন মিষ্টি পানির খোঁজে অনেকদূর ছুটছে। কিন্তু কোথাও পানি পাচ্ছে না। এছাড়া শ্যামনগর, আশাশুনি এবং কয়রা এলাকাজুড়ে গ্রামবাসী বৃষ্টির পানি ধরে রেখে সারাবছর তা পান করে থাকেন। এবার সেসব পানিতে এরই মধ্যে গ্যাস এবং পোকা দেখা দিয়েছে। ফলে সে পানিও তারা খেতে পারছে না। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পরিষদের ৫৭টি সরকারি পুকুর এবং কোন কোন স্থানের বেসরকারি পর্যায়ের পুকুরে পানি রিজার্ভ করে তা গ্রামবাসী খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করছেন। এইসব পুকুরে গবাদি পশু নামতে দেওয়া হয় না। এমনকি থালাবাসন ধোয়া ও গোসল করাও নিষিদ্ধ। কেবলমাত্র পানি তুলে নিয়ে তা ঘরে ঘরে শোধন করে ব্যবহার করা হচ্ছে। পানি সংকটের এই সুযোগে শহর ও গ্রামাঞ্চলের বেশ কিছু পানি ব্যবসায়ী শোধনাগার প্ল্যান্ট বসিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে তা বিক্রি করছে। এই পানি সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এমন অবস্থায় সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জেলাগুলির কয়েক লাখ মানুষ তীব্র পানির সংকটের মুখে পড়েছে। তবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কর্মকর্তারা জানান, বৃষ্টি নামলে এ অবস্থার উন্নতি হতে পারে।
এদিকে সাতক্ষীরা পৌর এলাকায় গ্রাহকদের বাড়িতে পানি সরবরাহ বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। কিছু এলাকায় পানি গেলেও শহরের বেশীরভাগ এলাকায় পৌরসভার পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব এলাকায় মানুষ ১২০০ ফুটেরও বেশি গভীর নলকূপ বসিয়ে নিজ নিজ পরিবারের পানির চাহিদা মেটাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খরা ও পানির স্তর স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে নিচে নেমে যাওয়ায় এবার দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় বিশুদ্ধ পানির হাহাকার চলছে। পানি সংকট প্রবণ এলাকার মানুষ নিরুপায় হয়ে বিশুদ্ধ ও লবণাক্ত পানি পান করায় ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, ফাঙ্গাল ইনফেকশন ও চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া নরম মাটি এলাকার ভূমি দেবে যাওয়া ও ফাটল ধরতে পারে বলেও আশঙ্কা আছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, বাংলাদের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বছরের মার্চ মাসে ২ হাজার ১১৫ মিলিমিটার এবং এপ্রিল মাসে ৫ হাজার ৪৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়া জরুরি। ২০২১ সালে মার্চ মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৮৪৪ মিলিমিটার, যেটা স্বাভাবিকের চেয়ে ৬০ শতাংশ কম হয়েছিল। আর ওই বছর এপ্রিল মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৬ হাজার ৫৫৭ মিলিমিটার, যেটা স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি ছিল। সে কারণে গত বছর পানির সংকট অনেকাংশে কম ছিল। কিন্তু চলতি বছরে এখনো বৃষ্টিপাতের পরিমাণ তেমন দেখা মেলেনি। পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে দেশের ৭৫ শতাংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২-৩ মিটার নিচে নেমে যায়।
এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকার গভীর ও অগভীর ভূ-স্তরের মাত্রাতিরিক্ত আয়রন ও আর্সেনিকের উপস্থিতি এবং উপযুক্ত ভূ-গর্ভস্থ পানির আধারের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে নিরাপদ পানিপ্রাপ্তি বিঘিœত করে। উপকূলীয় এলাকায় পলিমাটির আধিক্য ও গভীর নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অঞ্চলগুলোতে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে শুষ্ক মৌসুমে খরা, অনাবৃষ্টি ও বিলম্বিত বৃষ্টিপাতের কারণে পুকুর ও খাল শুকিয়ে যাওয়ায় চলতি বছরে উপকূলীয় এলাকার বেশির ভাগ জায়গাতে মানুষ সুপেয় পানির চরম কষ্টে পড়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি,কালিগঞ্জও তালা,খুলনার দাকোপ, কয়রা, বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ এলাকায় পানযোগ্য পানি খুবই দুষ্পাপ্য। এসব এলাকার বেশির ভাগ উপজেলায় গভীর নলকূপ কার্যকর নয়। এখানে বসবাসরত মানুষ বর্ষার মৌসুমের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ৩ থেকে ৪ মাস খাওয়া ও রান্নার কাজে ব্যবহার করে।
স্বল্পসংখ্যক পুকুরই তখন হয়ে ওঠে সুপেয় পানির প্রধান উৎস। এসব এলাকার সীমিত সংখ্যক পুকুর, সিডর, আইলা ও আম্ফানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ জলাশয় ও দীর্ঘস্থায়ী খরার কারণে এ বছর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা জটিল আকার ধারণ করেছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী বলেন, শুষ্ক মৌসুমে নদ-নদীতে পানি না থাকা এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া বাংলাদেশের নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বছর বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে দক্ষিণাঞ্চলসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এ সমস্যা নিরসনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …