আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: আমের স্বর্গরাজ্য সাতক্ষীরার গোবিন্দ ভোগ আম দেশের গোন্ডি পেরিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। জেলা ব্যাপি আম আর আম। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আম সংশ্লিষ্টদের কর্মব্যস্ততার যেন শেষ নেই। আম পাকতে শুরু করায় বেশ জোরেশোরেই আম পাড়া এবং বেচাকেনার উৎসব শুরু হয়েছে। শুক্রুবার ব্যবসায়ীরা এ মৌসুমের আমের প্রথম চালান ঢাকাতে পাঠিয়েছে। আম কিনতে দেশের পাইকারী ব্যবসায়ীরা এখন সাতক্ষীরাতে ব্যস্ত সময় পার করছে। ভৌগলিক কারণে দেশে প্রথম আম পাকে সাতক্ষীরায়। তাই মৌসুমের প্রথম আম পেতে ফলপ্রেমীদের কাছে সাতক্ষীরা আমের চাহিদা বেশি। প্রথম দিনে জেলা থেকে প্রায় ১০ ট্রাক গোবিন্দভোগ ও গোপালভোগ আম ঢাকাতে পাঠানো হয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান। চলতি মৌসুমে কয়েক কোটি টাকার আম ক্রয়-বিক্রয় হবে বলে আম ব্যবসায়ীরা মনে করছেন। তবে সিন্ডিকেটের কারণে আমের প্রকৃত দাম না পাওয়ার শঙ্কায় চাষিরা। তবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গাছে ফলন কম হওয়ায় এ বছর সকল আম ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখে পড়বেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর গরমের তীব্রতায় আগেভাগেই আম পেকেছে। বড় জাতের গোবিন্দ ভোগ আম ২হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা দরে মণ বিক্রি হচ্ছে । সরকারি নির্দেশনায় বৃহস্পতিবার (৫ মে) থেকে জেলাব্যাপী গোবিন্দভোগ গাছ থেকে আম ভাঙা শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা । গত ২৭ মার্চ সরকারি কর্মকর্তা ও আম ব্যবসায়ীদের নিয়ে মতবিনিময় সভায় জেলায় আম ভাঙার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয় জেলা প্রশাসন। সেখানে ৫ মে গোবিন্দভোগ, গোপালভোগ, বোম্বায়, ক্ষীরশাপাতি, গোলাপখাস ও বৈশাখীসহ অন্যান্য স্থানীয় জাতের আম, ১৬ মে হিমসাগর, ২৪ মে ল্যাংড়া ও পহেলা জুন আম্রপালি আম ভেঙে বাজারে তোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, গত বছর ৪ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছিল। চলতি বছর ৪ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে। আবাদ বাড়লেও এ বছর ৫০ ভাগ গাছেই আসেনি আমের মুকুল। জেলায় ৫ হাজার ২৯৯টি আমবাগান ও ১৩ হাজার আমচাষি রয়েছে। এ বছর সারাদেশ থেকে ৬০০ মেট্রিকটন আম বিদেশে রপ্তানি করা হবে। শুধু সাতক্ষীরা থেকে যাবে ১০০ মেট্রিকটন আম। আর এসব রপ্তানির কাজে নিরাপদ আম বিদেশে পাঠাতে বছরজুড়ে চাষিদের নানা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছে কাঁচা ও পাঁকা আমের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত না করে বিদেশ থেকে আম জাত পণ্য রপ্তানি করায় কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে দেশীয় আম শিল্প। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের অভিশপ্ত প্রভাবে গ্রীষ্মকালে ৪০-৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা এবং শীতকালে ৪-৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ৩৭% উর্বর জমি মরুভূমিতে পতিত হচ্ছে। তেমনি নতুন নতুন রোগ ব্যাধি দেখা দিয়েছে আমের ফলনে। ফলে বহুমুখী উপযোগিতা হারাচ্ছে তেমনি স্বাভাবিকভাবে আমের উৎপাদনও কমে আসছে।
এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে যে, বিদেশ থেকে বৈধভাবে যে পরিমাণ ফল আমদানি করা হয়, রপ্তানি করা হয় তার ৬২ ভাগের ১ ভাগ। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৭,৪৬৬ হেক্টর জমি থেকে ৮,৮৯,১৭৬ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয় (বিবিএস, ২০১২)। বর্তমানে আমের উৎপান প্রায় দ্বিগুণ। বিশ্বের প্রধান দশটি আম উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম এবং আগাম জাতের আম উৎপাদনে সাতক্ষীরা জেলা প্রথম। আম আমাদের দেশে মৌসুমি অর্থকরী ফল হিসেবে গুরুত্ব পেলেও একে শিল্পজাত পণ্য হিসেবে প্রক্রিয়াজাতকরণের কার্যকর গবেষণা অদ্যাবধি না নেয়ায় হুমকীর মুখে পড়তে যাচ্ছে আম চাষ।
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার ভারে আক্রান্ত। সাধারণ জনগণের অপুষ্টি দূরীকরণে, বেকারত্ব দূরীকরণ তথা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আম শিল্পের বিকাশ পুরোপুরি ঘটিয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে আমদানি ও রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নার্সারি পর্যায়ে আম চারা উৎপাদন একটি ব্যবসায়, কৃষক পর্যায়ে আম চাষ লাভজনক কৃষি পণ্য, ব্যবসায়ী পর্যায়ে মৌসুমি ব্যবসায় হিসেবে বিবেচিত হলেও আমকে শিল্পের পর্যায়ে ভাবা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে যে পরিমাণ কোমল পানীয়, বিদেশি জুস, জ্যাম, জেলি ইত্যাদি আমদানি করা হয়; আমকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে তা পণ্যে রূপান্তর করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব।
বিশেজ্ঞরা বলছে যদি দেশে এ জাতীয় পণ্য রপ্তানি করতে না হয় তাহলেই তো দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা দেশেই থাকতো; তদুপরি বিদেশে রপ্তানি করতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ফলে দেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তন ঘটতো। ফল বিশেজ্ঞরা বলছে, অর্থনৈতিক দিক থেকে আমের অবদান কোনো অংশে কম নয়, আন্তর্জাতিক মানের এই ফলটি শুধু পুষ্টি ও স্বাদের জন্যই বিখ্যাত নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কয়েক জন ব্যসায়ীর সাথে কথা হলে তারা জানান, কয়েক বছর ধরে তারা সাতক্ষীরা থেকে আম কিনে ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলাতে বিক্রয় করে। কিন্তু তারা লেনদেন করতে নিরাপত্তাহীন মনে করেন। আবার জেলার অনেক আম ব্যবসায়ী বাজারের আড়ৎদারদের কাছে জিম্মি বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ আড়ৎদারদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে ব্যবসা করার কারণে বাগানের সমস্ত আম উঠার পর আড়ৎদারদের কাছে সেই আম বিক্রি করতে বাধ্য হতে হয়। ফলে সিন্ডিকেটের কবলে পড়তে হয় জেলার গোটা আম ব্যবসায়ীদের। একটি আম উৎপান থেকে ভোক্তার বাড়ী পর্যন্ত পৌছাতে ৮ থেকে ১০বার হাত বদল হয়। এতে আমের দামকয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। শুধু আড়ৎতে আম উঠানোর করণে আড়ৎদারদের শতকরা আট থেকে দশ টাকা হারে খরচ দিতে হয়।
এ ব্যাপারে খামারবাড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের অন্য জেলার তুলনায় ১৫-২০ দিন আগে সাতক্ষীরার আম পরিপক্ক হয়। সে কারণে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জকে পেছনে ফেলে রপ্তানি বাজারে বেশি গুরুত্ব পায় সাতক্ষীরার আম।’তিনি বলেন, ‘বিদেশে রপ্তানি হওয়া আম বাগানগুলোতে আগে থেকে তত্ত্বাবধান শুরু করে কৃষি বিভাগ। যেন কোনো চাষি ওই বাগানগুলোতে কীটনাশক প্রয়াগ করতে না পারে। সম্পূর্ণরূপে বিষমুক্ত আম রপ্তানি হয় বিদেশে।’
Check Also
আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি
এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …