আবু সাইদ বিশ্বাস,সাতক্ষীরা: উপকূলের কৃষিতে নারীদের সম্পৃক্ততা যেমন বাড়ছে তেমনি কর্মজীবী নারীরা মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। তাদের অভিযোগ পুরুষের সমান কাজ করলেও নারীরা পুরুষের সমান মজুরি পান না। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এ বৈষম্য আরো বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের জীবন-জীবিকা ও কর্মসংস্থান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। জীবিকার তাগিদে কর্মক্ষেত্রে মজুরিবৈষম্য মেনে নিয়েই কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকতে হচ্ছে তাদের। ঘরের কাজ সেরে বাইরের কাজে শরিক হচ্ছেন তারা। মালিকরা ‘সস্তা শ্রমে কাজটা আদায় করার জন্য নারী শ্রমিকদের আগ্রহ করছে। ফলে দিনে দিনে কৃষিতে তাদে চাহিদা বাড়লেও মজুরি বৈষম্য কমছে না।রাষ্ট্র্রীয়ভাবে ন্যূনতম মজুরি কাঠামো না থাকায় নারীদের কম মজুরি দিয়ে বঞ্চিত করছেন মালিকর বলে তাদেও অভিযোগ।
চলতি মৌসুমে বোরো ধান ক্ষেত থেকে কেটে ঘরে তুলতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে। পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকের মজুরি কম হওয়ায় দিন দিন উপকুলীয় জেলাগুলোতে কৃষিতে পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। ফসলের বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ এমন কি বিপণন পর্যন্ত বেশিরভাগ কাজ উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা এককভাবেই করে আসছে। বর্তমানে দেশে নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষির সাথে জড়িত। ফসল উৎপাদনের ২১টি ধাপের ১৭টিতেই নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ রয়েছে।
সসমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পানিতে লবণাক্ততা বাড়ায় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে নারীরা। বাধ্য হয়ে এ জনপদের মানুষ তার জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে পেশার পরিবর্তন করছে, কর্মসংস্থানের খোঁজে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের জীবন-জীবিকায় জলবায়ুর প্রভাব মারাত্মক। এর ফলে নারীদের কর্মসংস্থানহীনতা বেড়েছে, পরিবর্তন করতে হচ্ছে তাদের জীবন-জীবিকা ও পেশার ধরণ।
দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে নারীরা কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও কৃষিখাত এবং অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে নেই। উপকূলীয় এলাকাগুলোতেও জীবন-জীবিকায় এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে উপকূলের নারীরা পিছিয়ে নাই মোটেও। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে পুরুষের চেয়ে এ অঞ্চলের নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং কর্মসংস্থানেও পিছিয়ে পড়ছে। শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুযায়ী কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণকারী মোট জনসংখ্যা ৫৮.২ শতাংশ। এর মধ্যে নারীদের কর্মসংস্থানের হার ৩৬.৩ শতাংশ এবং পুরুষের হার ৮০.৫ শতাংশ। অর্থনৈতিকখাতে নারীদের শতকরা ৬০ শতাংশ কৃষিতে, ১৭ শতাংশ শিল্পে এবং ২৩ শতাংশ সেবা খাতে জড়িত। অপরদিকে, পুরুষদের শতকরা ৩২ শতাংশ কৃষিতে, ২২ শতাংশ শিল্প এবং ৪৬ শতাংশ সেবা খাতে জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে একদিকে কৃষি ক্ষেত্রে পুরুষদের অংশগ্রহণ যেমন দিনে দিনে কমছে অন্যদিকে নারীদের কর্মসংস্থানহীনতাও বেড়েছে।
সাম্প্রতিক বেশ কিছু গবেষণা প্রতিবেদন দেখা গেছে, উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পুরুষদের চেয়ে নারীর ওপর বেশি পড়েছে। দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে পুরুষেরা জীবিকার কারণে বড় বড় শহরসহ অন্য এলাকায় চলে গেলেও নারীরা বসতবাড়ি পাহারা দেয়। পরিবারের সদস্যদের দেখাশুনা করার জন্য থেকে যেতে হয়। এসবের পাশাপাশি নারীদের অর্থনৈতিক কাজেও অংশগ্রহণ করতে হয়।
কৃষিশুমারি ২০১৯ অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় মোট ৯৮.৬৬ শতাংশ পরিবার পল্লী এলাকায় বসবাস করে। যার মধ্যে ৫৩.৮২ শতাংশ কৃষি পরিবার। বর্তমানে দেশের মোট শ্রমজীবী মানুষের ৪০.৬ শতাংশ কৃষির সঙ্গে যুক্ত; এদের মধ্যে ৭২.৬ শতাংশ নারী। শ্রম জরিপ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে এসে কৃষিতে নারীর সংশ্লিষ্টতা ৬৮.৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৪.৬ শতাংশ হয়েছে। নারী কৃষকরা মূলত খাদ্যশস্য উৎপাদন করছেন, জৈব কৃষি চর্চা করছেন।
সাম্প্রতিক বেশ কিছু গবেষণা প্রতিবেদন দেখা গেছে, উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পুরুষদের চেয়ে নারীর ওপর বেশি পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট যে কোনো দুর্যোগ নারীকে আরো বেশি বিপদে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি চাকরি তথা আনুষ্ঠানিক খাতে নারী-পুরুষের বেতন-বৈষম্য অনেকটা কম হলেও অনানুষ্ঠানিক খাতে বৈষম্য এখনো তীব্র। কাজের মধ্যে পুরুষরা বিশ্রামের বিরতি নিলেও নারীরা তা তেমন নেন না; কিন্তু পুরুষরা ৪০০ টাকা মজুরি পেলে নারীরা পান অর্ধেক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর মতে ২০১১ সালের জরিপে সাতক্ষীরা জেলা মোট জনসংখ্যা ছিল ১৯ লক্ষ ৮৫ হাজার ৯৫৯ জন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ১০ লক্ষ ৩ হাজার ১৮২ জন এবং পুরুষের সংখ্যা ৯ লক্ষ ৮২ হাজার ৭৭৭ জন। সাতক্ষীরা জেলা পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে বর্তমানে জেলাতে পুরুষ ও মহিলার সংখ্যা ২৫ লাখের বেশি। জেলায় প্রায় ৫ লক্ষ নারী বছরের বিভিন্ন সময়ে শ্রম বিক্রি করে থাকেন।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান বলেছেন, কৃষির উন্নয়ন ও কৃষি অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে নারী কুষি শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রাধিকার দিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ পূর্ণাঙ্গ মধ্যম আয়ের দেশের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। নারীদের অধীকার রক্ষায় বর্তমান সরকার কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নারীদের প্রতি বৈষম্য কমাতে যা যা করণীয় সরকার তাই করবে।
আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: ১৩/৫/২০২২
০১৭১২৩৩৩২৯৯