থানায় যোগ দিয়েই গ্রেফতার বাণিজ্য শুরু করেন এমদাদ

সাতক্ষীরা থানায় ৩ দিন থাকার পর নিখোঁজ
এক সপ্তাহে ৪১ লাখ টাকা ঘুষ আদায় * ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা লুট * ঝিনাইদহ থানায়ও অপকর্ম
 সিরাজুল ইসলাম ও আব্দুল্লাহ আল মামুন

 ০৪ নভেম্বর ২০১৮, ১২:০০ এএম
থানায় যোগ দিয়েই গ্রেফতার বাণিজ্য শুরু করেন এমদাদ

হোমিও চিকিৎসক মোখলেছুর রহমান জনিকে আটক এবং সাতক্ষীরা সদর থানা হেফাজত থেকে তার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ওসি এমদাদুল হক শেখের অপকর্মের যেন শেষ নেই।

নতুন কর্মস্থলে (থানায়) যোগ দিয়ে তিনি গ্রেফতার বাণিজ্য শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে এক সপ্তাহে ৮৭ জনের কাছ থেকে ৪১ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ারও অভিযোগ আছে। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তিনি টাকা আদায় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০১৬ সালের ৪ আগস্ট জনিকে আটক করে সাতক্ষীরা থানা পুলিশ। এর তিন দিন পর থানা হেফাজত থেকে জনি নিখোঁজ হন। তাকে আটকের বিষয়টি পুলিশ অস্বীকার করলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।

এ ঘটনার পরপরই সাতক্ষীরা সদর থানার ওসি এমদাদুলকে একই জেলার কলারোয়া থানায় বদলি করা হয়। ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট কলারোয়া এবং ২০১৭ সালের ২ জুন ঝিনাইদহ সদর থানায় তিনি যোগ দেন। এর আগে মৌলভীবাজার ও যশোরসহ বিভিন্ন স্থানে তিনি কর্মরত ছিলেন।

যেখানেই তিনি ছিলেন সেখানেই তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ ওঠে। বর্তমানে তার কর্মস্থল ঝিনাইদহ। এখানেও তিনি অবাধে অপকর্ম করছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা।

জানতে চাইলে ওসি এমদাদুল হক শেখ যুগান্তরকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে সেসব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমার কাছে অনেকে সেবা নিতে আসেন। সবাইকে খুশি করা সম্ভব হয় না।

যাদের খুশি করতে পারিনি বা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা আমার বিরুদ্ধে ওঠেপড়ে লেগেছেন। অরাজকতা করতে না পারায় রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাকর্মী আমার ওপর ক্ষুব্ধ। পুলিশের একটি গ্রুপও আমাকে প্রতিপক্ষ মনে করে। তাই তারা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, ওসি এমদাদের বিরুদ্ধে জমা পড়া কিছু অভিযোগের তদন্ত শেষ হয়েছে। কিছু অভিযোগের তদন্ত এখনও চলছে। তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে।

এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। মানবাধিকার কল্যাণ ট্রাস্টের ঝিনাইদহ শাখার এক নারী নেত্রী যুগান্তরকে বলেন, ওসির কাছে আইনি সহায়তার জন্য গেলে তিনি শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চান।

এতে রাজি না হওয়ায় ২১ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করেন ওসি এমদাদ। এ বিষয়ে ওই নেত্রী ঢাকায় ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে ২৪ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনও করেন।

৭ সেপ্টেম্বর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সৃজনী ফাউন্ডেশনের ভবন থেকে মহেশপুর উপজেলার গৌরীনাথপুর গ্রামের আবদুল কাদেরের ছেলে আরিফ হুসাইনকে উদ্ধার করে সদর থানা পুলিশ।

এ ঘটনায় আরিফ অপহরণ মামলা করলে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এজাহার থেকে সৃজনী ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী একেএম হারুন-অর রশিদ ও তার ছেলে তামীমের নাম বাদ দেয়া হয় বলে আরিফের অভিযোগ।

২৬ অক্টোবর হলিধানী বাজার থেকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত আবদুল বারীকে ধরে নিয়ে নাশকতার ‘সাজানো’ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। ৩ সেপ্টেম্বর সাবেক পৌর মেয়র আবদুল মালেক তার লাইসেন্স করা রিভলবার ও ৪৫ রাউন্ড গুলি থানায় জমা দিয়ে রসিদ নেন।

কিন্তু বাড়ি ফেরার সময় থানার প্রধান গেটের সামনে থেকে তাকে আটক করা হয়। পরে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দেয়া হয়। মালেকের স্ত্রী ফিরোজা আক্তার রোজী যুগান্তরকে বলেন, ওই মামলায় রিভলবারসহ ২০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার দেখানো হয়েছে।

২০১৬ সালের ২০ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ওসি এমদাদুল হক শেখের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা কলারোয়া থানার বিভিন্ন ইউনিয়নের আওয়ামীপন্থী ১০টি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান লিখিত অভিযোগ করেন। সে সময় কলারোয়া থানায় তিনি ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

অভিযোগে বলা হয়, যোগদানের পর থেকেই ওসি এমদাদ গ্রেফতার বাণিজ্য শুরু করেন। সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে ক্রসফায়ার ও নাশকতার মামলা ও মাদক দিয়ে চালান করার ভয় দেখিয়ে তিনি লাখ লাখ টাকা আদায় করেছেন।

বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের আটকের পর টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, ওসি তার বাণিজ্য ঠিক রাখতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুবলীগের একটি উচ্ছৃঙ্খল বাহিনীকে ব্যবহার করেন।

এতে বলা হয়, যশোর কোতোয়ালি থানায় থাকার সময় দুর্নীতির অভিযোগে ওসি এমদাদ সাময়িক বরখাস্তও হন। পরে তাকে সিলেট রেঞ্জ অফিসে সংযুক্ত করা হয়।

অভিযোগে আরও বলা হয়, মেয়ের চিকিৎসার জন্য পাটুলিয়া গ্রামের আবদুর সাত্তার সরদার ধারদেনা করে ২৩ হাজার টাকা সংগ্রহ করেন। ওসির নির্দেশে পুলিশ সাত্তারের বাড়িতে হানা দিয়ে ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ওই টাকা লুট করে।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এক সপ্তাহে বিভিন্ন গ্রামের ৮৭ জন লোকের কাছ থেকে ওসি তার লোকজন দিয়ে ৪১ লাখ টাকা আদায় করেছেন। অভিযোগকারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা হলেন- সোনাবাড়িয়ার মনিরুল ইসলাম, চন্দুনপুরের মনিরুল ইসলাম ননি, দেয়ারার গাজী মাহবুব রহমান, কুশোডাঙ্গার আসলামুল আলম, লাঙ্গলঝাড়ার নুরুল ইসলাম, কেঁড়াগাছির আফজাল হোসেন হাবিল, যুগিখালীর রবিউল হাসান, জালালাবাদের এ কে আজাদ, কেরালতলার আবদুল হামিদ ও হেলাতলার মোয়াজ্জেম হোসেন।

পুলিশ সদর দফতরের সিকিউরিটি সেলে একই ধরনের অভিযোগ জমা দিয়েছেন ঝিনাইদহের আদর্শপাড়ার এক ভুক্তভোগী। এতে বলা হয়, গ্রেফতার ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামের ১৬ ব্যক্তির কাছ থেকে ওসি এমদাদ ১৭ লাখ টাকা নিয়েছেন। যাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়েছে তাদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে।

স্থানীয় বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, একের পর এক ‘গায়েবি’ মামলায় আসামি করে চালানের ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করছেন ওসি এমদাদ। ঝিনাইদহ জেলা পুলিশের উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, কলারোয়া থানায় থাকাকালে ওসি এমদাদুল একটি স্বর্ণের চালান জব্দ করে তা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১১-১২ সালে সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানায় থাকাকালে দুই কনস্টেবলের কাছ থেকে পদোন্নতির জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ নেন তিনি।

কিন্তু তাদের পদোন্নতি হয়নি। টাকাও ফেরত দেয়া হয়নি। এ নিয়ে বিভাগীয় মামলা হলে শাস্তিস্বরূপ ওসি এমদাদুলকে পদ এক ধাপ অবনমনের নির্দেশ দেয় পুলিশ সদর দফতর। উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করায় তার পদাবনতি কার্যকর হয়নি।

স্থানীয়রা জানান, ১৩ সেপ্টেম্বর একটি প্রাইভেট কার ও ৪০ ভরি স্বর্ণের বারসহ এক চোরাকারবারি আটক করে পুলিশ। আটক স্বর্ণের মূল্য আনুমানিক ১৯ লাখ টাকা। ঝিনাইদহ-মাগুরা সড়কের পোড়াহাটীর দক্ষিণের একটি বাজার থেকে চালকসহ প্রাইভেট কারটি আটক করা হয়েছে দেখিয়ে মামলা করে পুলিশ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রাইভেট কারটি ধরা হয় পোড়াহাটীর ১০ কিলোমিটার দূরে হাটগোপালপুর বাজার থেকে। ঘটনাস্থলে অনেক লোকজন জড়ো হয়ে যাওয়ায় ‘স্বর্ণ আত্মসাতের অভিপ্রায়ে’ সেখান থেকে প্রাইভেট কারটি হাটগোপালপুর নেয়া হয়। পরে উদ্ধার করা স্বর্ণের বড় অংশ গায়েব করে ঘটনাস্থল পোড়াহাটী দেখানো হয়।

Check Also

সাতক্ষীরায় পুত্রবধূর হাতে নির্যাতিত সেই স্কুলশিক্ষক মারা গেছেন

ক্রাইমবাতা রিপোট, সাতক্ষীরা:   ছেলে ও পুত্রবধূর হাতে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের শিকার সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাঁশতলা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।