মহান আল্লাহর নিকট গৃহীত হজকে ইসলামি পরিভাষায় ‘হজে মাবরুর’ বলা হয় এবং মাবরুর হজের প্রতিদান একমাত্র জান্নাত। কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তোবা জানি না ‘হজে মাবরুর’ কী? এবং হজের সাথে কেন এ শব্দটিকে জুড়ে দেয়া হলো। ইসলামের অন্য কোনো ইবাদতের ক্ষেত্রে তো মাবরুর শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে হজের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের জন্য ‘মাবরুর’ শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
‘মাবরুর’ আরবি শব্দ, যা ‘বিররুন’ শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ হলো : মানুষের প্রতি ভালো আচরণ করা, অন্যের প্রতি কর্তব্য পালন করা এবং অন্যের অধিকার পূরণ করা। পরিভাষায়, বিররুন-এর বিপরীতধর্মী তিনটি কাজ না করা। এক. কারো সাথে ঝগড়া না করা। দুই. অশালীন কাজ না করা। তিন. গুনাহ না করা।
একজন হজযাত্রী স্বতন্ত্রভাবে আল্লাহর সম্মানিত মেহমান। ইহরামের কাপড় পরে মৃত ব্যক্তি সেজে হজব্রত পালন করেন হাজীগণ। হাজীরা নিজেকে আল্লাহর অনন্ত পথের যাত্রী ভেবে এবং সেভাবে নিজের মুখটি শুধু আল্লাহর জিকরে রতো রেখে পুরো হজ অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করেন। নিজের আভিজাত্য, মহাসম্মানিত পদবি, আকাশচুম্বী সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান এই ক’দিনের জন্য ভুলে থাকতে হয় হাজী সাহেবকে। আল্লাহর একজন নগণ্য বান্দা হিসেবে নিজেকে অন্য হাজীভাই/বোন বা সফলসঙ্গীদের জন্য বিলিয়ে দিতে হয় হজযাত্রীকে। অপরের প্রতি ভালো আচরণ করা, প্রতিটি কাজে অপরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবেই হজটি হবে হজে মাবরুর।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, পবিত্র হজব্রত পালনকালীন ৪০-৪৫ দিনের ক্রমাগত বিররুন-এর অনুশীলনের কারণে হাজীদের চরিত্রে ‘বিররুন’ স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধে। যখন একজন হাজী দেশে আসবেন তখন প্রতিবেশী ও সমাজ মাবরুর হাজী’র চরিত্রে বিররুন-এর প্রতিফলন দেখতে পাবেন। হজে যাওয়ার আগের মানুষের সাথে বর্তমান মানুষটির ভিন্নতা খুঁজে পাবেন সমাজের মানুষ। হজের পূর্বে যে মানুষটি মানুষের সাথে খারাপ আচরণ করতেন, গালিগালাজ করতেন, নিজের স্বার্থ রক্ষায় মরিয়া উঠতেন, মানুষের অধিকারের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন কিন্তু এখন তার একটিও এখন বিদ্যমান নেই। হজ পরবর্তী সময়ে মানুষের সাথে ভালো আচরণ করা, অপরের দুঃখে অন্তরাত্মা কেঁদে ওঠা, ঝগড়া এড়িয়ে চলা, উত্তম চারিত্রিক মাধুর্য দ্বারা মন্দ কথা বা কাজের জবাব দেয়া হজে মবরুরের নিদর্শন।
হজ কবুলিয়াতের বাধা সমূহ :
ক. বিমান অফিসের সব ফরমালিটি শেষ করে শুনলেন আপনাদের নির্ধারিত বিমানটি এক ঘণ্টা বা আরো বেশি সময় বিলম্ব হবে। আপনার মেজাজ বিগড়ে গেল। বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য শুরু হয়ে গেল। এটি আপনার মাবরুর হজে প্রথম বিপদ বা বাধা। খ. বিমানে বাথরুমে লাইন ধরেছেন। আরে লোকটি এতক্ষণ কী করে। বাথরুমে ঢুকে দেখলেন পুরোটাই ময়লা করে রাখা হয়েছে। গেঁয়ো, অসভ্য বা অন্যান্য ভাষায় মন্তব্য শুরু করলেন। মাবরুর হজে দ্বিতীয় আঘাত হলো। গ. এভাবে নানা অব্যবস্থাপনার সমালোচনা, সাথীদের ডিঙিয়ে ভালো সিটের জন্য প্রতিযোগিতা, অন্যের গায়ে ধাক্কা, অশালীন মন্তব্য- মাবরুর হজের বাধা। ঘ. ধাক্কাধাক্কি করে হাজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়া হজে মাবরুরের সম্পূর্ণ বিরোধী। দূর থেকে বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার বলে তাওয়াফ শুরু করলেই হয়। ঙ. তাওয়াফ শেষে দুই রাকাত নামাজ মাকামে ইবরাহিমের কাছাকাছি পড়া উত্তম। কিন্তু এই উত্তম কাজ করতে গিয়ে অন্যের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ানো হজে মাবরুরের বিরোধী। বরং এর চেয়ে ভালো হয়, সেখান থেকে সরে এসে একটু নিরিবিলি জায়গায় খুশু-খুজুর সাথে নামাজ পড়া।
উপসংহার : পবিত্র হজের বিভিন্ন পরিভাষার মধ্যে ‘হজ্জে মাবরুর’ অন্যতম। এটাকে কবুল হজও বলা যায়। তবে হাদিসে ‘হজে মাবরুর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ভাষায় শব্দটির বিভিন্ন অর্থ বা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বটে; কিন্তু সব কথার সার একটিই। তা হলো- হজে যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ থেকে বেঁচে থেকে পাপমুক্ত হজ সম্পাদিত হওয়াকে ‘হজ্জে মাবরুর’ বলে।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজ্জে মাবরুরের প্রতিদান হচ্ছে- শুধুই জান্নাত। তাই প্রত্যেকে হজ পালনকারীই প্রত্যাশা করেন, যেন তার হজটি ‘হজ্জে মাবরুর ’ হয়। মনে রাখতে হবে, হজ্জে মাবরুরের জন্য প্রধান শর্ত হচ্ছে- নিয়তকে পরিশুদ্ধ করা। ইখলাস তথা একনিষ্ঠতার সঙ্গে হজের নিয়ত করা এবং শেষ পর্যন্ত বিশুদ্ধ নিয়ত ও একনিষ্ঠতার ওপর অবিচল থাকা। একমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ পালন করা। সেই সঙ্গে হজের প্রতিটি আমলের ক্ষেত্রে হজরত রাসূল সা. এর পরিপূর্ণ অনুসরণ করা।
হজকে হজে মাবরুরে রূপান্তর করার জন্য নিজেদের মাঝে অযথা কথাবার্তা না বলে পুরো সময়জুড়ে জিকির-আসগার ও ইবাদতে মশগুল থাকতে হবে। গীবত, পরনিন্দা ও বিভিন্ন উপায়ে অন্য মুসলমান ভাইকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সব প্রকার গোনাহ ও পাপকাজ বর্জন করতে হবে। হজ সংশ্লিট প্রতিটি স্থানের প্রতি যথাযথভাবে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। এ ছাড়াও হজ আদায়কালীন সময়ে সৎ সঙ্গী গ্রহণ করা। সার্বিক ইবাদতের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করা এবং হজ পরবর্তী জীবনকে হজ পূর্ববর্তি জীবনের থেকে উত্তমভাবে পরিচালিত করার প্রচেষ্টা করা। দ্বীন ইসলামের ওপর অটল ও অবিচল থাকার প্রতিজ্ঞা করা। হজ আদায়রত অবস্থায় তাকওয়া’র সাথে জীবন পরিচালন ও অপরের অধিকার আদায়ের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করা জরুরি।