সাতক্ষীরায় উপকূল রক্ষা বাঁধে ভাঙ্গন: প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম: চরম ঝুঁকিতে উপকূলীয় এলাকার ৮ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ

আবু সাইদ বিশ্বাস ,সাতক্ষীরা: পৃথিবীর বৃহৎ বদ্বীপ বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত বাংলাদেশর উপকূলীয় অঞ্চলের অস্থিত্ব বিলীন হওয়ার সংকটে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অশুভ প্রবণতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের উপকূলভাগের লাখ লাখ মানুষ। নতুন করে সাতক্ষীরাায় উপকূল রক্ষা বাঁধে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে উপকূলের হাজার হাজার মানুষ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেড়িবাঁধ ভেঙে সাগরের নোনা পানিতে উপকূলভাগের হাজার হাজার একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। মাছের ঘের তলিয়ে গেছে জলোচ্ছ্বাসে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মেরামতে শভঙ্করের ফাঁকি থাকায় লাখ লাখ মানুষ জলোচ্ছ্বাসে ঘর ও জীবিকা হারিয়েছেন। দেশের সাগর তীরবর্তী অর্থাৎ উপকূলীয় ২১টি জেলায় লাখ লাখ মানুষের বসবাস। কিন্তু এই বিস্তীর্ণ উপকূলের যথাযথ সুরক্ষা না থাকায় উপকূলের রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধ ক্ষতবিক্ষত হয়ে আজ উপকূল বাসির জন্য অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে।

দেশের উপকূলীয় এলাকার ৮ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। গত বছর আম্পানে উপকূলীয় জেলার ১৫২টি স্থানে ৫০ দশমিক ৪৭৮ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে বিলীন হয়েছে। ৫৮৩টি স্থানে ২০৯ দশমিক ৬৭৮ কিলোমিটার আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ৪৮টি নদীর তীর ভাঙনে ১৩ দশমিক ২০৮ কিলোমিটার বিলীন হয়েছে এবং ৩৭টি নদীর তীর সংরক্ষণ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের ক্ষতি হয়েছে ১২ দশমিক ৮০০ কিলোটার। এই বিধস্ত উপকূলকে এখনো মেরামত করা হয়নি। ফলে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে ও টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে ভাসছে উপকূলের জেলাগুলো।

বাংলাদেশের উপকূলীয় পোল্ডারগুলো অনেক পুরোনো। বেশির ভাগেরই বয়স ৫০-৬০ বছরের বেশি। এগুলো মাটির তৈরি হওয়ায় এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। উপরন্তু চিংড়ি চাষের সুবিধার্থে লবণপানি ঢোকানোর জন্য যত্রতত্র বাঁধের ভেতরে ছিদ্র করায় বা পাইপ বসানোর ফলে জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে পোল্ডারগুলো । এছাড়া গঙ্গি ব্যারেজের কারণে ফারাক্কা বাঁধের জন্য ওপর থেকে পানি আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ওপর থেকে স্বাদু পানির প্রবাহ না থাকায় নদীর লবণাক্ততা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। উপকূলীয় অঞ্চলের সংসদ সদস্যরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে জনজীবনে সংকট প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাঁরা বলছে আগে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এই সংকট দেখা দিলেও এখন স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেই উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ফলে ওই অঞ্চলের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।

শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম দুর্গাবাটি এলাকায় ৫ নং পোল্ডারের উপকূল রক্ষা বাঁধের প্রায় দেড়শ ফুটেরও বেশী জায়গা পাশের খোলপেটুয়া নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে পশ্চিম দুর্গাবাটি এলাকার সাইক্লোন শেল্টার সংলগ্ন অংশের ঐ বাঁধ আকস্মিকভাবে নদীতে বিলীন হয়। এসময় আশপাশের এলাকাজুড়ে আতংক ছড়িয়ে পড়ে এবং স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ভাঙন কবলিত অংশে মাটি ফেলার কাজ শুরু করে। স্থানীয়রা জানিয়েছে উক্ত অংশে সংস্কার কাজের সময় গুনগত মান রক্ষা না হওয়াতে দেবে যাওয়া চরের উপরিভাগের বাঁধ নদীতে ধসে গেছে। বুড়িগোয়ালিনীতে ইউনিয়নের পশ্চিম দূর্গাবাটি সাইক্লোনশ্লেটার সংলগ্ন এলাকায় খোলপেটুয়া নদীর ২০০ ফুট এলাকাজুড়ে উপকুল রক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
এতে ৫ টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল পানিতে ভেসে গেছে। হাজার হাজার বিঘা মৎস্য ঘের পানির তলে। পানি বন্দী হয়ে পড়েছে শতাধিক পরিবার। স্থানীয়দের দাবি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের শ্যামনগরের ৫ নং পোল্ডারের উক্ত অংশের বাঁধ দীর্ঘদিন ধরে জরাজীর্ন অবস্থায় ছিল। কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নিতে গড়ি মশি করে।

দুর্গাবাটি গ্রামের নিলুৎপল মন্ডল জানায়, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ভাঙন কবলিত অংশের নিকটবর্তী চিংড়ি ঘেরে তারা কয়েকজন কাজ করছিলেন। এসময় আকস্মিকভাবে সাইক্লোন শেল্টারের পুর্ব প্রান্তের উপকূল বাঁধের প্রায় দেড়শ ফুটের বেশী জায়গা পাশের খোলপেটুয়া নদীতে ধসে পড়ে। এসময় চারিদিকে আতংক ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়দের পাশাপাশি পাশর্^বর্তী গ্রামসমুহ থেকে শত শত মানুষ ভাঙন কবলিত অংশে পৌছে ধসে যাওয়া বাঁধের ভিতর দিয়ে রিং বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেকশন অফিসার মাসুদ রানা জানান, নদীর চর দেবে যাওয়ার কারনে হঠাৎ খাড়াভাবে উক্ত অংশের বাঁধ নদীতে ধসে যায়। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি অবিহত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বারবার উপকূলবাসী দাবি উত্থাপন করে আর বারবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক উত্তর ‘কোন সমস্যা নেই সববাঁধা বাঁধা আছে’। কিন্তু দেখা যায় উল্টো। শনিবার সকালে খোলপেটুয়া নদীর উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙে আবারও প্লাবিত হলো আর বিপন্ন হলো মানুষের জনজীবন। স্থানীয় উপকূলবাসী আবারও অনুরোধ জানিয়েছে যেভাবেই হোক এই অবস্থার মধ্যে ত্রাণ সহায়তার আগে টেকসই বেড়িবাধের নিশ্চয়তা দিক সরকার।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ নির্বাহী প্র্রকৗশলী আবুল খায়ের জানান, এ প্র্রল জোয়ারের চাপে ভেঙে গেছে ঊপকূলীয় বেড়িবাঁধের ৪০মিটার মাটির রাস্তা। এছাড়া দূর্বল হয়ে গেছে ৪কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। ঝুঁকিপূর্ণও রয়েছে ২৫ থেকে ত্রিশটির মতো স্পট।
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী নজরুল ইসলাম জানান, খোলপেটুয়া নদীর দুর্গাবাটি পয়েন্টে বেঁড়িবাঁধ ভেঙে উপকূলের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের কমপক্ষে ৩টি গ্রামের মাছের ঘের, ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়ে গেছে। একের পর এক প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মো: হুমায়ুন কবির ৩টি গ্রাম প্লাবিত হতে পারে কিন্তু উপজেলা প্রশাসন তাকে জানিয়েছে ২৫টি গ্রামের মধ্যে মুলত তিনটি গ্রামের ১২০০ পরিবার এ মুহূর্তে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পরবর্তিতে অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির তথ্য ব্রিফ করে জানিয়ে দেওয়া হবে।

 

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।