আবু সাইদ বিশ্বাস,সাতক্ষরা: অবশেষে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের দুর্গাবাটি এলাকার খোলপেটুয়া নদীর ভাঙ্গনকৃত বেড়িবাঁধে সংস্কার শেষ পর্যায়ে এসেছে। তিন দিন ধরে হাজার হাজার মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে রক্ষা পেল উপজেলার ১২ গ্রামের লক্ষাধীক মানুষের জীবন। সকাল সর্বস্তরের মানুষের সাথে বাঁধ সংস্কারে অংশ নেয় উপজেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা আব্দুর রহমানের সাথে জামায়াত শিবিরের প্রায় পাঁচ শতাধীক নেতা কমীরা অংশ নেয়। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে তারা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ মেরামতের কাজে অংশ নেয় এবং জোয়ার আসার পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ দুপুর একটা পর্যন্ত তারা বিরতিহীন ভাবে বাঁধ সংস্কারের কাজ করেন।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের দুর্গাবাটি এলাকার খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভাঙে চয়দিন আগে। এতে ১২ গ্রামের লক্ষাধীক মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়ে।গত (১৪ জুলাই) বৃহস্পতিবার বিকেলে খোলপেটুয়া নদীর পানি জোয়ারে বৃদ্ধির কারণে আকস্মিক ধ্বসে যায় শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম দুর্গাবাটির সাইক্লোন শেল্টার সংলগ্ন এলাকার ৪০ মিটারের বেশি বেড়িবাঁধ। ওইদিন রাতেই সেখানে থেকে ধীরে ধীরে পানি লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। পরদিন সকালে প্লাবিত হয় দুর্গাবাটি গ্রামসহ ৫টি গ্রাম। ভাঙনের ৬ দিন অবহিত হলেও বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় সোমবার পর্যন্ত পূর্ব-পোড়াকাটলা, আড়পাঙ্গাশিয়া, দিরাই, বুড়িগোয়ালিনীসহ ১০-১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়। খাদ্য ও সুপেয় পানি সংকটে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। দুর্গাবাটি গ্রামের নারায়ন মন্ডল অভিযোগ করে বলেন, দুর্গাবাটির বিভিন্ন অংশে কোটি কোটি টাকার কাজ করা হলেও ভেঙে যাওয়া অংশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাটির কোনো কাজ করা হয়নি। এছাড়া প্রভাবশালীরা নদীর চর থেকে কোটি কোটি ঘনফুট বালু উত্তোলন করায় চর দেবে গেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কেউ তদারকি করেননি।
একই গ্রামের তপতী মন্ডল বলেন,বছর সাতেক আগে ঠিক একই জায়গা থেকে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এতে দুর্গাবাটি গ্রমের মিষ্টি জলের
উৎস ছিলনা। আর এবার ভেঙে যেয়ে জোয়ারের সময় বাড়ির মধ্যে জল উঠেছে। ভাটার সময়ে জল নেমে গেলেও জোয়ারের সময় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। রান্না করার জায়গা নেই। গরু ছাগল হাস মুরগী, বাচ্চা কাচা নিয়ে খুব দূভোগে রয়েছি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের শ্যামনগর অঞ্চলের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী জাকির হোসেন জানান, খোলপেটুয়ানদীর চর দেবে যাওয়ার কারণে ৪০ মিটার বাঁধ ধ্বসে পড়েছে। আমরা ১৬০ মিটার রিংবাঁধ দিতে সক্ষম হয়েছি। বাঁশ পাইলিংয়ের কাজ চলছে। তবে প্রবল জোয়ারের তোড়ে কাজ ধীর গতিতে এগুচ্ছে। রিংবাঁধ নির্মাণের জন্য ১৫ হাজার জিওব্যাগ ও ১লক্ষ সিনথেটিক ব্যাগ দিয়ে পানি আটকাতে সক্ষম হয়েছি। আজ খোলপেটুয়া নদীর ভাঙ্গনকৃত বেড়িবাঁধে সংস্কার শেষ হবে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আক্তার হোসেন জানান, বেড়িবাঁধের কাজ চলমান রয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার ও পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ওই অঞ্চলের সুপেয় পানির সংকট নিরসনে একটি পানির প্ল্যান্ট উদ্বোধন করা হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন এনজিও ও সেচ্ছাসেবী সংগঠন বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করছে। আশা করছি খুব দ্রুত আমরা এই অবস্থা থেকে নিরসন পাবো।
শ্যামনগর উপজেলা জামায়াতের আমীর অধ্যাপক আব্দুর রহমান জানান, আমাদের পক্ষ থেকে দুর্গত এলাকায় সার্বিক সহযোগীতা করেছি। ৫শ মানুষের খাবারের ব্যবস্থা আমরা করেছি। আসলে এভাবে জোড়া তালি দিয়ে বাঁধ সংস্কার করলে যো কোন মুর্হূতে তা আবার ভেঙ্গে যেতে পারে। তাই টেকশই ও স্থায়ী বাঁধ নির্মানের দাবী স্থানীয়দের ।
তিনি আরো বলেন,জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মাথায় রেখে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান দূর্গত উপকূলীয় এলাকায় স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জরুরি তহবিল গঠন করতে হবে।
তিনি বলেন,যতই সংস্কার করা হোক না কেন, ৬০ দশকে তৈরি করা আয়তনে ছোট উপকূলীয় বেড়িবাঁধ কোনভাবেই ওই অঞ্চলকে সুরক্ষা দিতে পারবে না। তাই দ্রুত জলবাযু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দূর্যোগকে বিবেচনায় রেখে নতুন পরিকল্পনায় বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে বাঁধের নিচে ১০০ ফুট ও উপরে ৩০ ফুট চওড়া করতে হবে।
সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি মানুষের সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে স্থানীয়রা, উপকুলীয় এলাকায় লবণ পানির বাগদা চিংড়ি রপ্তানি করে সরকার প্রতিবছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। কিন্তু সেই চিংড়ি চাষ এলাকায় লবণপানি উত্তোলনের জন্য যে দীর্ঘমেয়াদী সুপেয় পানির সংকট তৈরি হয়েছে, সেই সংকট উত্তরণে যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সুপেয় পানি প্রাপ্তির জন্য উপকূলীয় জনগণকে এনজিওদের ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এটি অমানবিক ও অমর্যাদাকর।
বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতার মধ্যে গত ২০ মে সুপার সাইক্লোন আম্ফান উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ঘূর্ণিঝড় ও জ্বলোচ্ছাসে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে জনজীবন বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় ঘূর্ণিঝড় দুর্গত উপকূলীয় মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে টেকসই ও স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচী রেখেছে বিভিন্ন সংগঠন।