উপকূল রক্ষায় সরকারের গৃহীত ডেল্টা প্লান কাজে আসছে না: পানি ঢুকছে লোকালয়ে: দুশ্চিন্তায় উপকূলের লাখ লাখ মানুষ

আবু সাইদ  বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ নিম্ন চাপের প্রভাবে উপকূল অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাতে নদ-নদীর পানি উপকূল রক্ষার বাঁধ উপচে লোকালয়ে ঢুকছে । এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় উপকূলের লাখ লাখ মানুষ। বার বার ক্ষতি গ্রস্থের পরও উপকূল রক্ষায় নেই কোনো মাস্টার প্লান, আছে শুধুই জোড়াতালি। সমুদ্রের মুখে ১৫ ফুট উচ্চতার বেড়িবাঁধগুলো নির্মিত হয় ৬০’র দশকে। বর্তমানে ক্ষয় হয়ে ১৩-১৪ ফুট আছে এগুলোর। আরও ভেতরে নদী ঘিরে নির্মিত হয়েছিল ১০-১২ ফুট উচ্চতার বাঁধ। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেসব বাঁধ এখন প্রায় নিশ্চিন্ন। উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষায় একটি সমন্বিত বাঁধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গৃহীত ডেল্টা প্লানের কথা বলা হলেও তার সুফল এখনো দৃশ্যমান হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নেদারল্যান্ডস, চীন, জাপানের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় ২০৩১ সালের মধ্যে টেকসই বাঁধ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে ইতিমধ্যে পাশ হয়েছে ৩৭ বিলিয়ন ডলারের বাজেট। প্রতিবছর ৩.৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সাতক্ষীরার শামনগর থেকে কক্সবাজার শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ৭১০ কিলোমিটার উপকূলের মানুষ এ প্রল্পের সুফল। কিন্তু কাগজে কলমে ডেল্টা প্লানের কথা বলা হলেও বাস্তবে তার কোন প্রতিফল দেখতে পাচ্ছে না উপকূল বাসি।
বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূল এলাকার মানুষ সব সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের সহায় সম্বল হারিয়ে নি:স্ব হয়ে যায়। প্রতিবছর একেক সময় একেক রকম দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয় উপকূলের মানুষদের। কখনো ঝড় আবার কখনো নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে পানিতে প্লাবিত হয়ে। ঘূণিঝড় ইয়াসের পরে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে কাজ করলেও শুভংকরের ফাঁকি দিয়েছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারা। কিন্তু ইয়াসের পরে উপকূলের ১৪৯ কিলোমিটার এলাকায় বেড়িবাঁধের ২৯টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান রয়েছে। ইয়াসের আগে বুলবুল ঝড়ের পরে ৪৩টা ঝুঁকিপূর্ণ স্থান ছিলো। ইয়াসের পরে ১৪টি পয়েন্টের কাজ হলেও এখনো ভালোভাবে কাজ শেষ করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। খুব দ্রুত যদি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো কাজ না করা যায়, তাহলে অতিরিক্ত নদীর জোয়ারের পানিতে উপকূলের মানুষ তাদের সর্বস্ব হারাবে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের মধ্যে মুন্সীগঞ্জে ৩টি, বুড়িগোয়ালীনিতে ৫টি, গাবুরায় ৭টি, পদ্মপকুরে ৮টি, কাশিমাড়ীতে ১টি, আটুলিয়ায় ১টি পয়েন্টগুলো খুব ঝুঁকিপূর্ণ।
সাতক্ষীরার মুন্সীগঞ্জ বড় ভেটখালী গ্রামের সাইফুল ও রবি সরদার বলেন, আম্পানের সময় বড় ভেটখালির গোড়া ভাঙন দেখা দেয়। তারপরে সেটা ঠিক করা হয়নি। সামনে যে ঝড় আসছে সে ঝড়ের আগে যদি এ ভাঙনে কাজ করা না হয়, তাহলে বাঁধ ভেঙে যাবে। ক্ষতি হবে এলাকার হাজার হাজার বিঘার জমির মৎস্য সম্পদ। হরিনগর সিংহড়তলী গ্রামের বিশ্বজিত রায় বলেন, ইয়াসের পরে সিংহড়তলীর ভাঙন দেখা দেয়। পানি উন্নয়ন বোডের্র লোকদের বলার পরও কাজ করেনি। সামনে যে অশনি ঝড় আসছে সে ভয়ে আতঙ্কে আছি। যদি ভেঙে যায় তাহলে আমারদের সব ধ্বংস হয়ে যাবে। বুড়িগোয়ালীনির দূর্গাবাটি গ্রামের দিনেশ মন্ডল ও রতি রাণী বলেন, ইয়াসের সময় বাঁধ ভেঙে ঘর বাড়ি সব পানি উঠে গাছপালা নষ্ট হয়ে গেছে। এখনো লাগাতে পারেনি। আবার শুনছি নতুন করে অশনি নামের ঝড় আসবে। আমাদের ওবদার রাস্তাগুলো ঠিক করে দিলে আর পানিতে ভাসতাম না।
বিশেজ্ঞরা বলছে নদীকে ঘিরে পোল্ডার করার প্রক্রিয়া আমাদের দেশীয় প্রযুক্তি। বসতি স্থাপনের শুরু থেকেই বেড়িবাঁধ করে বসবাস করে আসছে এ অঞ্চলের মানুষ। দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত বেড়িব বাঁধ এতোটাই কার্যকর যে, চব্বিশ পরগণায় এখনও হাজার বছরের পুরোনো পোল্ডার চোখে পড়ে। কিন্তু যতবার ঘূর্ণিঝড় হয়, ততবার এই একই পরামর্শ শোনা যাচ্ছে প্রায় দুই দশক ধরে। এর সঠিক বাস্তবায়ন দেখা যায়নি এতোদিনেও। শুধু শ্যামনগরে এখানে ২৮ কিলোমিটারের মধ্যে ৮টি পয়েন্ট খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয় পানি উন্নয়ন বোর্ড শ্যামনগর উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী মাসুদ রানা বলেন, আমরা অতিরিক্ত জোয়ারের কারণে নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে সে জন্যে সম্পর্ণ প্রস্তুতি রয়েছি পর্যপ্ত জিআইও ব্যাগসহ প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র রেডি আছে। অনেক জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কাজ চলমান রয়েছে এবং অনেক কাজ হয়ে গেছে।
এদিকে আশাশুনি উপজেলার শোভনালী ইউনিয়নে নতুন খননকৃত বাঁশদহা নদীর বাঁধ ভেঙে এলাকায় পানি ঢুকে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। রবিবার বেলা ৩টার দিকে কৈখালী গ্রামের কাছে বাঁধ ভেঙে যায়। স্থানীয় ইউপি সদস্য শিক্ষক উদয় কান্তি বাছাড় জানান, পুন:খনন করা বাঁশদহ নদীর জোরারের পানির তোড়ে বিকাল ৪টার দিকে কৈখালী গ্রামের কাছে বাঁধ ভেঙে যায়। বাঁধের ২০/৩০ হাত এলাকা ভেঙে পানি ভিতরে ঢুকছে। মুহূর্তের মধ্যে কৈখালী, সেনেরচক, কামালকাটি ও বসুখালী গ্রাম, বিল ও ঘের প্লাবিত হয়ে যায়। উপজেলার প্রতাপনগর, শ্রীউলা, আনুলিয়া, খাজরা ও আশাশুনি সদরের ঝুঁকিপূর্ণ ওয়াপদা বাঁধ নিয়ে এলাকার মানুষের মনে শঙ্কা বিরাজ করছে। এছাড়া বুধহাটা, বড়দল ও কুল্যা ইউনিয়নের কিছু স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ রয়েছে।
রবিবার সকালে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহ নেওয়াজ তালুকদার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ সোনাতনকাটি, শ্রীপুর কুড়িকাহুনিয়া লঞ্চ ঘাটের দক্ষিণ ও উত্তর পাশে, মাদার বাড়িয়া, ঝাপালি, বন্যতলা ক্লোজারের পশ্চিম অংশের অবস্থা সরেজমিন দেখতে যান। বাঁধ রক্ষায় জরুরী কাজ হবে বলে নির্বাহী প্রকৌশলী জানান।প্রতাবনগর ইউপি চেয়ারম্যান হাজী আবু দাউদ ঢালী জানান, সরকারি ভাবে বেড়িবাঁধ রক্ষার জন্য কাজ করা হলেও এখনো কিছু স্থানে খুবই ঝুঁকি বিরাজ করছে। আমরা বারবার কাজ এগিয়ে নিতে তাগাদা দিলেও সম্ভব হয়নি। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে চলিতি বর্ষা ও ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুমে পুনরায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। নানা শঙ্কায় ইউনিয়নের ৩৬ হাজার মানুষ দুশ্চিন্তায় রয়েছে।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।