জরায়ুতে ক্যান্সার ঝুকি বাড়ছেঃ সাতক্ষীরায় নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যজনিত ঝুঁকি নিয়ে গভীর উদ্বেগ

আবু সাইদ ,সাতক্ষীরাঃ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক নারী মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। লবণাক্ত পানির কারণে নারীরা এখন জরায়ু ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে ভুগছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর যে কয়েক লাখ নারী জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ উপকূলীয় অঞ্চলের নারী। নারীদের জরায়ুসংক্রান্ত অসুখের তীব্রতা লবণাক্ততাপ্রবণ গ্রামগুলোতে বেশি। সে জন্য অল্প বয়সেই এ এলাকার নারীরা জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে জরায়ুসংক্রান্ত রোগে ভুগছেন এমন নারীর সংখ্যা অহরহ। সাতক্ষীরায় সুন্দরবন উপকূলে লোনা পানির প্রভাব ও নারীর স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিষয়ক সেমিনার গতকাল সাতক্ষীরায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেমিনারে বক্তারা লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যজনিত ঝুঁকি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে নারীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে সমস্বিতভাবে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গ্রহণ, বিস্তর গবেষণা ও সুনির্দিষ্ট তহবিল গঠন করার উপর গুরুত্বারোধ করেন। শনিবার সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের সভা কক্ষে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক এই সেমিনারের আয়োজন করে।

‘সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবে লবণাক্ততা প্রভাব’ শীর্ষক একটি গবেষণায় বলা হয়, উপকূলীয় অঞ্চলে নারী ও কিশোরীরা মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় ধুয়ে আবারো সেটি ব্যবহার করে এবং লবণাক্ত পানিতে গোসলসহ দৈনন্দিন কাজের কারণে তাদের জরায়ুসংক্রান্ত রোগের উপস্থিতি অনেক বেশি। উপকূলের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই জরায়ুসংক্রান্ত রোগে নারীরা আক্রান্ত, ডাক্তাররা রোগীদের জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন। নারীদের পুরো জরায়ু কেটে ফেলার পর অনেকের স্বামী তাদের ফেলে অন্যত্র বিয়ে করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীদের গর্ভপাতের হার বেড়ছে। সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার বিভিন্ন উপজেলার গর্ভবতী নারীদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণা অনুযায়ী, অতিরিক্তি লবণাক্ত পানি গ্রহণের ফলে নারীদের জরায়ু রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভকালীন খিঁচুনি, গর্ভপাত, এমনকি অপরিণত শিশু জন্ম দেয়ার হার বেড়েছে। এছাড়া নারীরা দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজ, গোসল, কৃষি কাজ, গবাদিপশু পালন, চিংড়ির পোনা ধরাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে নারীরা লিউকোরিয়াসহ সাধারণ পানিবাহিত রোগ এবং চর্মরোগের সংক্রমণে বেশি আক্রান্ত হয়।
সূত্র বলছে, গত কয়েক দশকে উপকূলীয় এলাকায় পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে যে উষ্ণায়ন, পরিবেশের বিপন্নতা তার প্রভাব প্রথম এসে পড়ে নারীর ওপর। পানির স্তর নিচে নেমে যায়, নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে যায়, নদী শুকিয়ে যায়, দুই-একটি নলকূপে, যেখানে মিষ্টি পানি ওঠে সেখানেও পানির জন্য হাহাকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা না হলে কলসি নিয়ে পানির খোঁজে দীর্ঘপথ হাঁটা। জ্বালানির জন্য কাঠ সংগ্রহ করতে নারীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনের ভেতরে যেতে হয়।
উপকূলীয় জেলা ক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে চুল ও ত্বকের ক্ষতি হয়। রং কালো হয়ে যায় ও দ্রুত বার্ধক্য চলে আসে। এছাড়া গর্ভপাত ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। সেখানকার নারী ও শিশুরা চিংড়িপোনা ধরার জন্য ভাটার সময় ভোরে ও দিনের বেলায় ফলে প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা তাদের লবণাক্ত পানিতে থাকতে হয়। এর ফলে প্রজনন স্বাস্থ্যসহ নারী অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন
জার্মান ওয়াচ গ্লোবাল-এর জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই-২০২০) অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ শীর্ষ দশ দেশের একটি। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃসরকারি প্যানেল (আইপিসিসি) ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, বাংলাদেশ ২০৫০ সালের মধ্যে এর ১৭ শতাংশ জমি এবং খাদ্য উৎপাদনের ৩০ শতাংশ হারাতে চলেছে।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীদের গর্ভপাতের হার বেড়ছে। লবণাক্ত পানিতে চিংড়ির পোনা ধরা, মাছের ঘেরে কাজ করা, লবণাক্ত পানি পানসহ দৈনন্দিন কাজে নারীকে সবচেয়ে বেশি সময় থাকতে হয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার নারীদের গর্ভপাতের প্রধান কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ত পানি বৃদ্ধিই দায়ী। ইউএনডিপির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী— গর্ভবতী নারী এবং কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ক্রমেই প্রকট হচ্ছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির দৈনিক ৫ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু উপকূলীয় এলাকাতে জনগোষ্ঠীকে দৈনিক ১৬ গ্রামের অধিক লবণ খেতে হচ্ছে, যা দেশের অন্য এলাকার জনগোষ্ঠীর তুলনায় অনেক গুণ বেশি।
খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলার গর্ভবতী নারীদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণা অনুযায়ী, অতিরিক্তি লবণাক্ত পানি গ্রহণের ফলে নারীদের জরায়ু রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভকালীন খিঁচুনি, গর্ভপাত, এমনকি অপরিণত শিশু জন্ম দেয়ার হার বেড়েছে।
সরকার বলছে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর বিশেষত নারীদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লবণাক্ততা মোকাবিলায় অভিযোজন বা সহনশীলতার সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ছয় বছর মেয়াদি (জানুয়ারি-২০১৯ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪) একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত¿ণালয়ের অধীন মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ৫টি উপজেলার (কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, আশাশুনি ও শ্যামনগর) ৩৯টি ইউনিয়নের সাত লাখ মানুষ এ সুবিধা পাবে।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. হুসাইন শাফায়েত বলেন, বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ ও জনস্বাস্থ্যের বিষয়। শ্যামনগর উপকূলে একটি পাইলট স্ট্যাডি করতে পারে লবণাক্ততা ও নারীর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নিয়ে। আমাদের চিকিৎসকদেরকেরও গবেষণা কাজে আরও বেশি যুক্ত হওয়ার দরকার। এভিডেন্স বেজ প্রাকটিস এবং এভিডেন্স বেজ ট্রিটমেন্ট আরও বেশি বাড়ানো দরকার।

 

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।