ডেস্ক রিপোট: জোট ছাড়ার বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্যে ২০ দলীয় শিবিরে তোলপাড় অবস্থা বিরাজ করছে। যদিও জামায়াতের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে দাবি করা হচ্ছে, এটি তাদের দলীয় আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নয়। ঘরোয়া ভার্চুয়াল বৈঠকে জামায়াতের আমিরের বক্তব্যে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়েছে তা জোট ছাড়ার ঘোষণা নয়। অপরদিকে বিএনপিতে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ বলছেন, বক্তব্যটি আমলে নেওয়া হবে, কেউ আবার এক ধাপ এগিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন, সবাই আমরা যুগপৎ আন্দোলনে আছি। তবে আওয়ামী লীগ মনে করছে, এটি তাদের (বিএনপি-জামায়াত) রাজনৈতিক কৌশল।
বিশ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান দুদল বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের টানাপোড়েন চলে আসছে। বিএনপির একটি অংশ জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে অনেক আগে থেকে সরব। কিন্তু অপর অংশটি ভোটের রাজনীতিতে ফায়দা নিতে জামায়াতকে কাছে রাখতে চায়। বিএনপিতে থাকা জামায়াত বিরোধীরা প্রকাশ্যে বিভিন্ন সময়ে কথা বললেও জামায়াতের পক্ষ থেকে কেউ কখনও মুখ খোলেননি। তবে এই প্রথম জোট ছাড়া নিয়ে জামায়াত আমিরের ঘরোয়া ভার্চুয়াল বক্তব্যটি রোববার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়। দেশজুড়ে ২০ দলীয় জোটে নানা কৌতূহল ও প্রশ্ন দেখা দেয়।
সম্প্রতি দলের ঘরোয়া এক ভার্চুয়াল সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডা. শফিকুর রহমান নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা এতদিন একটা জোটের সঙ্গে ছিলাম। ছিলাম বলে আপনারা হয়তো ভাবছেন কিছু হয়ে গেছে নাকি? আমি বলি হয়ে গেছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি একটি জোট ছিল। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর জোট তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়ে ছিল। সেটা আর ফিরে আসেনি।’ তিনি বলেন, ‘বছরের পর বছর এ ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না। এই জোটের সঙ্গে বিভিন্ন দল যারা আছে, বিশেষ করে প্রধান দলের (বিএনপি) এ জোটকে কার্যকর করার কোনো চিন্তা নেই। বিষয়টা আমাদের কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট এবং তারা আমাদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে হ্যাঁ জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করব।’ বিএনপির সঙ্গে জোট নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে জামায়াতের আমির আরও বলেন, ‘আমরা তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছি, এর সঙ্গে তারা ঐকমত্য পোষণ করেছে। তারা আর কোনো জোট করবে না। এখন যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করব। আমাদের আগামী দিনগুলোতে কঠিন প্রস্তুতি নিতে হবে এবং অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।’
জামায়াতের শীর্ষ নেতার এই বক্তব্য নিয়ে বিএনপিসহ জোটের অন্য শরিক দলেও নানা প্রতিক্রিয়া ও আলোচনা চলছে। কিছুদিন আগের (প্রায় ২ মাস) বক্তব্যের ভিডিও হঠাৎ করে এখন কেন সামনে নিয়ে আসা হয়েছে-তা নিয়েও চলছে নানা পর্যালোচনা। বক্তব্য আমলে নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারাও। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘যারা যার অবস্থানে থেকে যুগপৎ আন্দোলন হবে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের জন্য বাম-ডান, মধ্যপন্থি, ইসলামপন্থি সব দল যার যার অবস্থান থেকে এই আন্দোলনে শরিক হবেন। তিনি তার (জামায়াত আমির) বক্তব্যে এটিই বুঝিয়েছেন।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘ভিডিওটি দেখেছি। জামায়াতের আমির সেখানে দলীয় অবস্থান জানিয়েছেন। আমরা এখন সেটিকেই আমলে নেব।’
অবশ্য দলের আমিরের বক্তব্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে দাবি করে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী আছে, জোট ছাড়েনি। আমাদের ঘরোয়া একটি বৈঠকে তিনি (আমির) যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন তাতে এমন কোনো ঘোষণাও ছিল না। জোটের যে গুরুত্ব এবং তাৎপর্য বিএনপি সেটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না বলেই আমির তার মনোভাব প্রকাশ করেছেন।’
সূত্রমতে, আগামীতে ক্ষমতায় যেতে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায় এবং আন্দোলনের জন্য বৃহত্তর ঐক্য গঠনের ক্ষেত্রে ২০ দলীয় জোটের পুরোনো শরিক জামায়াতকে বাধা হিসাবে মনে করেন বিএনপির একটি অংশ। আবার ভোটের হিসাবে জামায়াতকে জোটে রাখার পক্ষে রয়েছে আরেক অংশ। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগামীতে বিএনপির জোটে জামায়াতকে না রাখা এবং রাখলেও কৌশলী অবস্থান বজায় রাখা নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে সিদ্ধান্তহীনতায় দলটি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার যুগান্তরকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী জোট ছেড়েছে এমন কোনো সংবাদ আমাদের কাছে নেই। তবে আমার কাছে মনে হয় না জামায়াত জোট ছেড়ে দেবে। যদি এই ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত জামায়াত গ্রহণ করে তাহলে তাদের ভুল সিদ্ধান্ত হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য যুগান্তরকে বলেন, রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। নির্বাচনকে সামনে রেখে দল-জোট গঠনে নানা মেরুকরণ হবে। জামায়াতের এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতার বৈঠকের বিষয়েও বিএনপির কাছে তথ্য রয়েছে। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরেও অনেকে বৈঠক করছেন। তবে বিএনপি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যেমে সরকার পরিবর্তনে বিশ্বাস করে। তবে দলের ভেতরে অনেকেরই মত, জামায়াত নিজেরাই আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে জোট ছেড়ে চলে যাক।
আবার জামায়াতের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা যুগান্তরকে জানান, তাদের সঙ্গে জোট হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে, অন্য কোনো নেতার সঙ্গে নয়। জোটে না থাকার বিষয়ে জামায়াত কোনো সিদ্ধান্ত দেবে না, দেবেন জোটনেত্রী খালেদা জিয়া।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে বড় শোডাউন, সিলেট অঞ্চলে বন্যাসহ নানা দুর্যোগে নির্বিঘ্নে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের তৎপরতা রাজনৈতিক মহলে নতুন বার্তা দেয় বলে অনেকে মনে করছেন। আবার আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে ১২০ আসনে জামায়াতের দলীয় প্রার্থী ঠিক করে রাখার গুঞ্জনও রয়েছে।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রথম কথা-আমরা বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাব না। তবে জামায়াতে ইসলামী একটি নির্বাচনমুখী দল। কাজেই আসনভিত্তিক নির্বাচনের কাজ সারা বছরই চলতে থাকে। এক্ষেত্রে অনেক জায়গায় প্রার্থী পরিবর্তন হয়েছে। এজন্য দলের একটা নির্বাচনের বিভাগ আছে, তারা প্রস্তাব তৈরি করে। আর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দলের কর্ম পরিষদ হলো পার্লামেন্টারি বোর্ড, যার প্রধান হলেন আমির।’ সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের বৈঠকের কথা জানা নেই।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম গতকাল টেলিফোনে নয়া দিগন্তকে বলেন, জামায়াত আমির ঘরোয়া একটি বৈঠকে এ কথা বলেছেন। ঘরোয়া বৈঠকে তো অনেক কথায়ই হয়। এতে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ছাড়ার কি কোনো ঘোষণা দিয়েছেন? আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দিতে হলে আমরা সংবাদ সম্মেলন অথবা প্রেস রিলিজের মাধ্যমে জানাবো।
এ দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইতোমধ্যে বেশকিছু জেলায় প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে জামায়াত। যদিও দলটির নিবন্ধন বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, প্রার্থী চূড়ান্ত করা জামায়াতের নিয়মিত সাংগঠনিক কাজের অংশ। প্রার্থীদের নার্সিং করতে এটা করা হয়। এটি স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। এটি বিগত সময়েও করা হয়েছে। এটি বিশেষ কোনো কিছু না।
স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ঐক্য করেছিল জামায়াত ও বিএনপি। আলাদা হলেও আওয়ামী লীগ আর বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন দুই জোটের যুগপৎ আন্দোলনেই পতন ঘটে এরশাদের। সংখ্যায় কম অথচ জামায়াতের সমর্থনে ১৯৯১ সালে সরকার গঠন করে বিএনপি। ফিরে আসে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে চারদলীয় জোট করে ফের ক্ষমতায় আসে বিএনপি ও জামায়াত। ২০০৬ সালের পর দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকলেও বিএনপি ও জামায়াতের জোট অটুট থাকে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের যুগপৎ কর্মসূচি তেমন দেখা যায়নি।