কলারোয়া সংবাদদাতা: কলারোয়া উপজেলার ৪০০ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য সোনাবাড়ীয়া মঠবাড়ির (শ্যাম সুন্দর মন্দির) সব প্রবেশ দ্বার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এনিয়ে বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সোমবার বিকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মঠবাড়ির সব ক’টি প্রবেশ পথ ইট দিয়ে গেথে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, আগত দর্শণার্থীদের অনৈতিক কর্মকা-, ছিনতাই আর নিরাপত্তাহীনতার কারণে মঠবাড়ির ভিতরে প্রবেশের পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়েছেন সোনাবাড়ীয়া শ্যাম সুন্দর মন্দির কর্তৃপক্ষ। তবে, এ বিষয়টি ইতিবাচক ভাবে দেখছেন স্থানীয় সর্বসাধারণ।
মঠবাড়ির ফুটেজ সংগ্রহের সময় সংবাদকর্মীর উপস্থিতি দেখে ছুটে আসেন আশাপাশের স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি। এসময় তারা জানান, ভ্রমণের নামে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ও জেলা থেকে আসা নারী পুরুষ এখানে এসে অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হচ্ছেন। ক্রমান্বয়ে পরিবেশ এতটাই নোংরা হয়ে গেছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আশাপাশে বসবাস করার অবস্থা নেই। এখানে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াত দিনদিন বাড়ছে। তারাও বিপদগামী হওয়ার উপক্রম। এদিকে, প্রতিনিয়ত এখানে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। সেই সাথে বাড়ছে বখাটেদের উপদ্রব। মূলত এমন সব কারণেই প্রাচীন এই ঐতিহ্য সোনাবাড়ীয়া মঠবাড়ির সব প্রবেশ পথ বন্ধ করা হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
সাতক্ষীরা সিটি কলেজের শিক্ষক স্থানীয় বাসিন্দা মো. জিয়াউল হক বলেন, আমি বিষয়টি ইতিবাচক মনে করছি। কারণ মঠবাড়িকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে যে অশ্লীলতা হচ্ছে তাতে আমাদের পুরো গ্রাম রসাতলে যেতে বসেছে। আমরা অনেকবার চেষ্টা করেও সেখানে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারিনি।
ঘুরতে আসা একাধিক দর্শণার্থী বলেন, আমরা দূর থেকে এখানে এসেছি। এসেই দেখি মঠবাড়ির সব প্রবেশ পথ বন্ধ। প্রাচীন এই প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখার অধিকার সবার আছে। অনৈতিক কর্মকা-ের অভিযোগ এনে প্রবেশ পথগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ না করে কর্তৃপক্ষ এখানে নিরাপত্তাকর্মী বা গার্ডের ব্যবস্থা করতে পারতেন। পুলিশ-প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে হলেও দর্শনীয় এই স্থানটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা উচিত।
সোনাবাড়ীয়া (মঠবাড়ি) শ্যাম সুন্দর মন্দিরের সভাপতি দেব প্রসাধ চৌধুরী বলেন, সোনাবাড়ীয়া মঠবাড়ি একটি প্রাচীণ ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থান। দর্শণার্থীদের জন্য এটি এতদিন উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু এখানে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের অবাধ আনাগোনা আর মেলামেশা পরিবেশকে খুব নোংরা করে ফেলেছে। আমরা স্থানীয়ভাবে অনেকবার চেষ্টা করেও সেটা বন্ধ করতে পারিনি। এখানে দিন-দুপুরে প্রকাশ্যে হচ্ছে ছিনতাই, চাঁদাবাজী। ঘুরতে আসা মানুষজনদের জিন্মি করে লুৎপাট করা হচ্ছে মোবাইল ফোন সহ টাকা পয়সা। দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে আশাপাশের মানুষজনের জীবন। এজন্য এলাকাবাসীর স্ব-উদ্যোগে মঠবাড়ির প্রবেশ পথগুলো বন্ধ করা হয়েছে। তবে, এখানে অবস্থিত মন্দিরের ভিতর দিয়ে মঠবাড়ির মধ্যে প্রবেশের একটি পথ উন্মুক্ত রয়েছে।
সোনাবাড়ীয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেনজির হোসেন হেলাল বলেন, মঠবাড়ির প্রবেশ পথ বন্ধ করার বিষয়টি আমি শুনেছি। মঠবাড়ির সাথেই রয়েছে একটি মন্দির। সেখানে নিয়মিত পূজা-অর্চনা হয়। আমি যতটুকু জানি মন্দিরের পবিত্রতা রক্ষার জন্য স্থানীয়রা মঠবাড়ির প্রবেশ পথ বন্ধ করেছেন। তবে, প্রাচীন এই দর্শনীয় স্থানটি রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রবেশ উন্মুক্ত রাখতে সরকারের প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহায়তা একান্ত প্রয়োজন।
এবিষয়ে কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুলী বিশ্বাস বলেন, আমি বিষয়টি সাংবাদিকদের মাধ্যমে জেনেছি। ইতোমধ্যে মন্দিরের সভাপতি/সেক্রেটারীর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন, অনৈতিক কর্মকা- ও বখাটেদের উৎপাত বন্ধে মঠবাড়ির ভিতরে প্রবেশের কয়েকটি পথ বন্ধ করা হয়েছে। তবে, বিষয়টি আমি আরও বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে দেখব।
সোনাবাড়িয়া মঠবাড়ি মন্দির
সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলায় অবস্থিত সোনাবাড়িয়া মঠবাড়ি মন্দির (Sonabaria Mothbari Temple) বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। সাতক্ষীরা থেকে ২৬ এবং কলারোয়া থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে সোনাবাড়ীয়া গ্রামে সোনাবাড়িয়া মঠবাড়ি মন্দিরটির অবস্থান। স্থনীয়দের কাছে সোনাবাড়ীয়া মঠ এবং শ্যাম সুন্দর মন্দির নামেও পরিচিত। তবে সোনাবাড়িয়া মঠবাড়ি মন্দিরের দেয়ালের শিলালিপিতে শ্যাম সুন্দর নবরত্ন মন্দির নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
শ্যামসুন্দর মঠ মন্দিরটি ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে জনৈক হরিরাম দাশ (মতান্তরে দুর্গাপ্রিয় দাশ) নির্মাণ করেছিলেন। এই পুরাকীর্তির সবচেয়ে বড় অংশটি হচ্ছে ত্রিতলবিশিষ্ট নবরত্ম মন্দির। এটিই এলাকায় ‘শ্যামসুন্দর মন্দির’ নামে পরিচিত। এর সঙ্গে রয়েছে দুর্গা মন্দির ও শিবমন্দির। প্রায় ৪০০ বছর পুরানো এই মন্দিরটি ৬০ ফুট উঁচু। পিরামিড আকৃতির এই মন্দিরের নিচের তলার ভিতরের অংশ চার ভাগ বিভক্ত। প্রথম অংশের চারপাশে ঘূর্ণায়মান টানা অলিন্দ রয়েছে। দ্বিতীয় অংশে রয়েছে একটি মন্ডপ। তৃতীয় অংশে কোঠা এবং প্রকোষ্ঠ দেখতে পাওয়া যায়। পূর্বদিকে একটি অলিন্দ থেকে উপরে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। মন্দিরের ছাদের ওপর ক্রমান্বয়ে ঊর্ধমুখি গম্বুজের মাঝখানে বড় একটি রত্ম রয়েছে, যার কারণে সোনাবাড়িয়া মঠবাড়ি মন্দিরটি নবরত্ম মন্দির হিসাবে পরিচিত।
জানা যায়, মঠ মন্দির গুচ্ছের দক্ষিণে ‘জমির বিশ্বাসের পুকুর’ নামে যে জলাশয়টি আছে তার পাকাঘাটে ব্যবহৃত ইটের সঙ্গে ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’ এর ইটের মিল পাওয়া যায়। তাতে ধারণা করা হয়, পুকুরটি একই সময়কার। জনশ্রুতি আছে, এক সময় “রামকৃষ্ণ পরমহংস” এই সোনাবাড়িয়া মঠে প্রায় দুই মাস অবস্থান করেন। একারণে হিন্দু ধর্মাম্বলীদের কাছে এই সোনাবাড়িয়া মঠবাড়ি মন্দিরের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।