খুলনায় বেড়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং

মহানগরী খুলনায় বিভিন্ন অপরাধ মাদক, অপহরণ, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, খুনসহ জখমের ঘটনা ঘটলেই তা শক্ত হাতে দমন করছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মাদক কারবারিদের দৌরাত্ম্য, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের মদদদাতা হিসাবে পর্দার আড়ালে থাকা প্রভাবশালী রাঘব-বোয়ালদের ছত্রছায়ায় খুলনার বিভিন্ন এলাকাতে গড়ে উঠছে ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং চক্র। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই গ্যাংয়ের সদস্যরা মুহূর্তের মধ্যে বেপরোয়া হয়ে হত্যাসহ নানামুখী অপরাধে নিজেদের সামিল করছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিবারিক কলহ, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, বেকারত্ব, নেশাসহ বিবিধ কারণে সমাজের নি¤œবিত্ত জীবন যাপন করা তরুণেরা ধীরে ধীরে বেপরোয়া ও ভয়ানক হয়ে উঠছে। এলাকার বড়ভাই, প্রভাবশালী মহল বা মাদক কারবারিদের ছত্রছায়ায় এসব কিশোর গ্যাং এর জন্ম হয়। এরপর এরা অনায়াসে নিজেকে লিপ্ত করে সমাজের ছোট-বড় অপরাধের সাথে। যা সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর অশনি সংকেত ডেকে আনছে।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) বেলা পৌনে ১১ টার দিকে নগরীর ৩ নং কাশেম সড়কের নুর মোহাম্মাদের দোকানের সামনে দিবালোকে ইয়াছিন আরাফাত (১৮) নামে এক একজন মাছ বিক্রেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার সোনাখাল গ্রামের বাসিন্দা মো. এমাদুল ইসলাম ওরফে ওবায়দুল্লাহ ফকিরের ছেলে ইয়াছিন নগরীর সান্ধ্য বাজারে মাছ বিক্রি করতেন। শুক্রবার তিনি ব্যবসা বন্ধ রাখতেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় বন্ধুদের সাথে তিনি আড্ডা দিতেন। ঘটনার দিন (শুক্রবার) সকালে ৩ নং কাশেম সড়কে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে আসেন। ওই সময় ১০/১২ জনের একদল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা তার ওপর আক্রমণ করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চাপাতি দিয়ে তার বুকে আঘাত করে। এতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অতঃপর তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে দুপুর ১২ টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহতের পিতা ওবায়দুল্লাহ ফকির বাদী হয়ে ওই দিন গ্রীনভিউ আবাসিক এলাকার গোলাম আকবর এর বাড়ির ভাড়াটিয়া মো. সুলাইমানের ছেলে মো. ইব্রাহিম ওরফে এল এক্স কাটার ওরফে নিরব (১৯), মো. সাকিব (১৯), নিরালা প্রান্তিকা ১০ নং গলি আয়তুন নেসার বাড়ির ভাড়াটিয়া মো. শাহাজাহান আলী গাজীর ছেলে মো. মাসুদ রানা (২০), নির্জন আবাসিক এলাকার ব্যাংকার্স কলোনীর বাসিন্দা কামালের ছেলে শোভন (২০), মিজান (২০), শেখপাড়া ফরিদের বাড়ির ভাড়াটিয়া মো. আলম হাওলাদারের ছেলে আব্দুল্লাহ (১৯), নাইম (১৯), মিলন (১৯), মো. অনিক (১৯) ও ৩নং কাশেম সড়ক তানভীরের বাড়ীর ভাড়াটিয়া মো. টুটুল হাওলারের ছেলে মো. আসিফ ওরফে ডার্বি (১৫)সহ অজ্ঞাত আরো ৬-৭ জন আসামী করে খুলনা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন (নং-১৩)। ঘটনার দিনই (শুক্রবার) পুলিশের অভিযানে ৩ জন আসামী ও র‌্যাবের অভিযানে ২ আসামীকে গ্রেফতার করেছে প্রশাসন। হত্যার সাথে জড়িত এজাহারভুক্ত আসামীদের গ্রেফতারে পুলিশ কাজ করছে বলে জানিয়েছেন তারা।

সুজন খুলনার সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট খুদরত-ই-খুদা জানান, অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালী মহলের প্রভাবে, মাদক কারবারিসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের মদদদাতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে উঠতি বয়সি তরুণরা বেপরোয়া আর ভয়ানক হয়ে উঠছে। এই সকল মদদদাতারা তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে নগদ অর্থসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র। যে কারণে তারা মুহূর্তের মধ্যেই যে কোনো অপরাধ করে ফেলে। পরে কি হবে ভেবে দেখার সময় নেই তাদের। ওই সকল তরুণেরা শহরের মধ্যে দলবদ্ধভাবে বেপরোয়া গাড়ি চালনা, হুটহাট গন্ডগোল, নেশাগ্রস্থ অবস্থায় ট্রাফিক আইন বহির্ভূত অতিগতিতে ইচ্ছা-স্বাধীন চলাচল করছে। ইভটিজিং করছে, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডে লিপ্ত হচ্ছে। এই কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে আরো স্বোচ্চার হতে হবে। পাশাপাশি কোনো একটা সময় আমাদের বসবাসরত পাড়া-মহল্লায় মুরব্বীদের একটা অনুশাসন ছিল যা আজ পুরাপুরি বিলুপ্ত। এই অনুশাসন পুনরায় চালু করা দরকার। যদিও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেফতারে র‌্যাবসহ পুলিশের বিশেষ অভিযানে আইনের আওতায় আনলেও বন্ধ হচ্ছে না কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে।

খুলনা সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. হাসান আল মামুন জানান, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা দমনে বিট পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে এলাকা ভিত্তিক গ্যাংয়ের সদস্য চিহ্নিত হলে তাদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। আমি মনে করি প্রশাসনের চেয়ে অভিভাবককে বেশি সচেতন থাকতে হবে। তাদের সন্তানদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব তাদেরই।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার পাশাপাশি, অভিভাবক ও সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমেই কেবল কিশোর গ্যাং চক্রের উৎপত্তি বা কেন্দ্রবিন্দু বন্ধ করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসী এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

Check Also

ঘোনা ইউনিয়নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন

আবুল হোসেন সদর প্রতিনিধি : ঘোনা ইউনিয়নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।