এর আগে সাবিনার আগমনের খবরে ফুটবল প্রেমী মানুষেরা ভিড় জমাতে থাকে সাতক্ষীরা শহরের সবুজবাগ এলাকায় অবস্থিত সাবিনাদের বাড়িতে। এদিন সাবিনাদের বাসায় যেয়ে দেখা যায়, সাবিনাদের বাড়ির ছোট্ট ড্রয়িং রুমটা সাবিনারই দখলে। নানা অর্জনের স্মারক আর ছবিতে সাজানো পুরো রুমটা। সেখানে সাবিনার ৫০, ১০০ আর ২৫০ গোল করার বাঁধানো স্মারক জার্সি। শোকেস ভরা বিভিন্ন ধরনের অভিনন্দনবার্তার স্মারকসহ বিভিন্ন গুণীজন ও সাবিনার ছবি শোভা পাচ্ছে ড্রয়িং রুমের দেয়ালে।
এসময় ড্রয়িংরুমের ভিতরে গেলে দেখা মেলে ড্রয়িংরুমের ঠিক এক কোণে মুঠোফোনের দিকে নিরবে কী যেন ঘেটে ঘেটে দেখছেন মধ্যবয়সী এক নারী। আর বারবার চোখের অশ্রু মুছে চলেছেন তিনি।
এসময় অশ্রুসিক্ত ওই মহিলার সাথে কথা হয় পত্রদূতের সাংবাদিকের। এসময় তিনি পত্রদূতের সাংবাদিককে জানান, যাঁর কারনে সাবিনা আজ নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছে তিনি সেই তৃণমূলের কোচ আকবার আলীর সহধর্মীণী রেহেনা খাতুন।
স্বামীর স্মৃতিচারণ করে সাবিনা খাতুনকে নিয়ে তিনি বলেন, তৃণমূলের ফুটবলের জন্য নিভৃতে কাজ করে গেছেন তার স্বামী আকবর আলী। তৃণমূলের নি:স্বার্থ একজন কোচ ছিলেন তিনি। আকবারের সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের স্ট্রাইকার সাবিনা খাতুনের কোচ।
তিনি বলেন, সাবিনা খাতুনসহ অসংখ্য মেয়েদের নিজের আগ্রহে ফুটবল মাঠে নিয়ে যেতেন আকবার আলী। নিজের বাড়িতে রেখে নিয়মিত অনুশীলন করাতেন সবাইকে। শুধু খেলা নয়, পড়াশোনার খরচও মেটাতেন খেলোয়াড়দের।
ফুটবলার সাবিনাই নয়, দেশের ফুটবলের প্রথম পেশাদার নারী কোচ ও সাবেক ফুটবলার মিরোনা খাতুন, জাতীয় দলের ফুটবলার সুরাইয়া খাতুন, মাসুরা পারভীনদেরও কোচ ছিলেন আকবর আলী। জাতীয় কাবাডি দলে খেলা একাধিক নারী খেলোয়াড় আকবর আলীর হাতে তৈরি। দেশের সাবেক দ্রুততম মানবী শিরিন এবং নিজের যমজ মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস ও ফাতেমা তুজ জোহরাও ছিলেন আকবর আলীর হাতে গড়া বলে জানান তিনি।
এসময় সাফ চাম্পিয়নশীপের শিরোপা অর্জন ও সাবিনার ব্যক্তিগত সাফল্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আবেগপ্রবণ হয়ে তিনি বলেন, এবারের সাফ চাম্পিয়নশীপ টুর্নামেন্টের কয়েক মাস আগে স্বামী আকবার আলী মারা যান। ওইসময় আকবারের তৃণমূলের সেরা কোচের পুরস্কারটা সাবিনা গ্রহণ করে আমাদের বাসায় পৌছে দেন। এরপর থেকে সাবিনার সাথে কথা হলেও কখনও দেখা হয়নি। শুধুমাত্র সাবিনার কারনে যশোর থেকে অনেক কষ্ট করে সাতক্ষীরা এসেছি জানিয়ে তিনি বলেন, আকবারকে কখনও সাবিনা স্যার বলতেন না। বড় ভাই বলে ডাকতেন। একজন অভিভাবক হিসেবে মানতেন। আজকে আকবার বেঁচে থাকলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
সাতক্ষীরায় মাঠ ও ফুটবল একাডেমি চান ক্যাপ্টেন সাবিনা
ক্রাইমবাতা রিপোট : সাফ বিজয়ী নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক ও স্ট্রাইকার সাবিনা খাতুন ও তার পরিবারের সদস্যদেরকে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে এ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনায় সাবিনা খাতুনের পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় কোচ প্রয়াত আকবার আলীর স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।
সাফ জয়ের পর নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন তার নিজ জেলা সাতক্ষীরায় এসেছেন শুক্রবার ভোর রাতে। ওই দিন বেলা এগারটায় সার্কিট হাউজ মোড় থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেয় বিভিন্ন সংগঠন। শনিবার দুপুরে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
সংবর্ধনা পেয়ে খুশি এই কৃতি ফুটবলার। তিনি জেলা প্রশাসনের কাছে মেয়েদের খেলার উপযোগী একটি মাঠ দাবি করেছেন।
সাবিনা খাতুনকে সংবর্ধনা দিতে পেরে আনন্দিত জেলা প্রশাসন। সাতক্ষীরায় নারী খেলোয়াড়দের এগিয়ে নিতে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির। তিনি
সাবিনা খাতুনকে ১লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন। এছাড়া সংবর্ধনায় উপস্থিত সাতক্ষীরা সদর আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি সাবিনা খাতুনকে ৩ লাখ টাকার সৌজন্য উপহার দিয়েছেন।
সংবর্ধনার জবাবে সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন বলেন, সাতক্ষীরাসহ বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমি মুগ্ধ। আমার বেড়ে উঠা এই সাতক্ষীরার মাটিতেই। এ মাটিতেই আমার শৈশব মিশে আছে। আমি যখন ফুটবল খেলা শুরু করি, তখন আমার স্বপ্ন ছিল সাউথ এশিয়ান কাপ বাংলাদেশকে উপহার দেবো। আমি সেটা দিতে পেরেছি। এটা আমার সার্থকতা। আমার পরিশ্রমের সার্থকতা। আমার শিক্ষক আকবর স্যার আজ নেই। উনার কথা অবশ্যই স্মরণ করতে হয়। আমি তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। আমার সাবিনা হয়ে ওঠার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন আমার আকবর স্যার। সাথে সাথে আমাকে যারা সাপোর্ট দিয়েছে তাদের সবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।
ফুটবল খেলাটা মেয়েদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে বড় লোকের ঘরের মেয়েরা ফুটবল খেলে না। গরিব নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা ফুটবল খেলে। কিন্তু খেলার সামগ্রী কেনার সামর্থ্য তাদের থাকে না। খেলায় ধরনের মানুষের অংশগ্রহণ একান্ত জরুরী। সাতক্ষীরায় ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সাতক্ষীরায় মেয়েদের জন্য মাঠের সংকট। জেলায় একটি স্টেডিয়াম আছে। কিন্তু সেখানেও সব সময় খেলার সুযোগ থাকে না। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ মাঠ ও পিটিআই মাঠ মেয়েদের খেলার জন্য উপযোগী নয়। এজন্য সাতক্ষীরায় মেয়েদের খেলার উপযোগী নির্দিষ্ট মাঠ প্রয়োজন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আকবর স্যার যখন আমাদের প্রাকটিস করাতেন তখন একশ্রেণির মানুষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো। তখন আমার বয়স ১২-১৩ বছর। সেই প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তিনি আমাদের গড়ে তুলেছেন।
সাতক্ষীরার অনুন্নত রাস্তাঘাট ও জলাবদ্ধতা বড় সমস্যা। এ সমস্যা সমাধান করা জরুরি। এজন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।