চাকরিচ্যুত হলেন জেলে বন্দি জেলার সোহেল

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার হিসাবে কর্মরত ছিলেন মো. সোহেল রানা বিশ্বাস। ২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। এই সময়ে চট্টগ্রাম কারাগারকে অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন সোহেল। বন্দি বেচাকেনা, জামিন বাণিজ্য, সাক্ষাৎ বাণিজ্যের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।

টাকার নেশা তাকে এমনভাবে ধরে বসে, এত অবৈধ অর্থ উপার্জন করেও সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না তিনি। জড়িয়ে পড়েন মাদক ব্যবসায়। এরপর ফেনসিডিল ও ৪ কোটি ২৪ লাখ টাকার নগদ অর্থ, চেক ও এফডিআর নিয়ে ধরা পড়েন রেলওয়ে পুলিশের হাতে। গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে বন্দি আছেন।

এই ঘটনার পর সোহেলের বিরুদ্ধে শুরু হয় তদন্ত। দীর্ঘ তদন্তে তার অপরাধ-অপকর্মের ফিরিস্তি উঠে আসে। তার বিরুদ্ধে অন্তত সাতটি অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় সম্প্রতি গুরুদণ্ড হিসাবে তাকে চাকরিচ্যুত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন থেকে গ্রেফতারের পর ২০১৯ সালের ১৩ জুন সোহেলকে বিভাগীয় কার্যধারা অনুযায়ী অসদাচরণে অভিযুক্ত করা হয়। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তাকে অভিযোগের বিষয়ে জবাব দিতে বলা হয়। তিনি সেই বছরের ১০ অক্টোবর জবাব দাখিল করেন। জবাবে তিনি অভিযোগগুলো থেকে অব্যাহতি চান। পাশাপাশি ব্যক্তিগত শুনানির ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু সোহেল তখন কারাগারে বন্দি ছিলেন। ফলে তার বিভাগীয় মামলার শুনানি গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

এরপর ন্যায়বিচারের স্বার্থে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব তাহনিয়া রহমান চৌধুরীকে চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। ২২ এপ্রিল তিনি প্রতিবেদন জমা দেন। ওই প্রতিবেদনে অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়। সেখানে উঠে আসে তার অপরাধ-অপকর্মের ফিরিস্তি।

প্রতিবেদনে উঠে আসে, কারা ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক এবং সিনিয়র জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরীর আর্থিক অনৈতিক সম্পর্কের কারণে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে অনিয়ম ও দুর্নীতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্মকালে সোহেল বন্দি বেচাকেনা, জামিন বাণিজ্য, সাক্ষাৎ বাণিজ্য, কারা হাসপাতাল ও ওয়ার্ডে ভর্তি-স্থানান্তরের নামে অবৈধ উপায়ে অর্থ আদায়ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন।

সোহেল কারা বিধিবহির্ভূতভাবে ক্যান্টিন পরিচালনা করতেন। বন্দি পিসি ব্যতীত নগদ টাকায় ক্যান্টিনের মালামাল বন্দিদের মাঝে বিক্রি করতেন। সেখান থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ থেকে প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা (ভেতর ও বাহির ক্যান্টিন মিলে) এবং প্রতিদিন ২৫ হাজার টাকা (শুধু ভেতর ক্যান্টিন থেকে) অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে গ্রহণ করেছেন তিনি।

তদন্তে আরও উঠে আসে, সোহেলের কর্মকালে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে গেট আর্টিক্যাল রেজিস্টার যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হতো না। এভাবে তল্লাশি ছাড়া মালামাল ও অবৈধ জিনিসপত্র কারাগারে প্রবেশ করানো হতো। পিসি এন্ট্রিকারী কারারক্ষীদের মাধ্যমে নগদ টাকা বন্দিদের কাছে পৌঁছে দিয়ে কমিশন আদায়ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন সোহেল। ক্যান্টিন পরিচালনার নীতিমালা না মেনে বিধিবহির্ভূতভাবে খরচ করতেন তিনি।

পিসি ক্যাশের লভ্যাংশের অর্থ ব্যাংকে জমা না দিয়ে হাতে রেখে ক্যান্টিন পরিচালনা নীতিমালা ও আর্থিক বিধি লঙ্ঘন করেছেন এই চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা। ইতঃপূর্বেও তার বিরুদ্ধে একাধিক বিভাগীয় মামলা হয়েছে। ওই মামলাগুলোতে তাকে শাস্তিও প্রদান করা হয়েছে। তার ‘অভ্যাসগত দুর্নীতি ও অনিয়ম’র সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত।

৬ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, তদন্ত প্রতিবেদনসহ দাখিলকৃত কাগজপত্রাদি, তথ্যপ্রমাণ এবং প্রাসঙ্গিক সব বিষয় পর্যালোচনায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনীত ‘অসদাচরণ’র অভিযোগটি প্রমাণিত হয়। চলতি বছরের ১৯ মে ‘চাকরি থেকে বরখাস্তকরণ’র বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয় এবং সোহেলকে দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। ৭ জুন তিনি নোটিশের জবাব দেন। তবে সেটি সন্তোষজনক না হওয়ায় গুরুদণ্ড আরোপের পূর্ব সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়।

২৯ জুন এ বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়কে অনুরোধ করা হয়। কর্ম কমিশন সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রস্তাবিত গুরুদণ্ড আরোপের পরামর্শ প্রদান করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মো. সোহেল রানা বিশ্বাসকে সরকারি ‘চাকরি হতে বরখাস্ত’ করা হয়। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রজ্ঞাপনে।

২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবর ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনে ময়মনসিংহগামী বিজয় এক্সপ্রেসের একটি বগি থেকে জেলার সোহেলকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার কাছে থাকা একটি ট্রলি ব্যাগে নগদ ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, আড়াই কোটি টাকার তিনটি এফডিআর’র কাগজ, ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার তিনটি ব্যাংক চেক, পাঁচটি চেক বই ও ১২ বোতল ফেনসিডিল পাওয়া যায়। পরে তার বিরুদ্ধে ভৈরব রেলওয়ে থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করে রেলওয়ে পুলিশ।

এরপর ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ আরেকটি মামলা করেন কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আবু সাঈদ। মামলায় ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ২৩৫ টাকার জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে ৪০ লাখ ২৭ হাজার ২৩৩ টাকা মূল্যের সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুদক আইনের ২৬(২) ও ২৭(১) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় অভিযোগ করা হয়।

Check Also

হামাসের সঙ্গে সংঘর্ষে ৩৫ ইসরাইলি সেনা নিহত, আহত শতাধিক

গাজার উত্তরে জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে দীর্ঘদিন ধরে অভিযান চালাচ্ছে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী। সম্প্রতি সেখানে হামাস …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।