খাদ্য নিরাপত্তার মারাত্মক ঝুঁকিতে উপকূলীয় অঞ্চল: ওএমএসের চাল কিনতে মানুষের দীর্ঘ লাইন

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ ভৌগলিক অবস্থান, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভঙ্গুর অবকাঠামো, স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ, দারিদ্রতা, দীর্ঘমেয়াদী লবণাক্ততা, সংকটাপন্ন কৃষি, প্রভৃতির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে ঝুঁকির মুখে পড়েছে খাদ্য নিরাপত্তা। বিশেষ করে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল গুলোর মধ্যে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলা অন্যতম। গত কয়েক দর্শকে এ অঞ্চলে বৃদ্ধি পেয়েছে লবণক্ষতা হ্রাস পেয়েছে কৃষিতে উৎপাদন। ফলে চলতি মৌসুমে কৃষকের ঘরে ঘরে চলছে এখন হা-হা কার। ৩০ টাকা কেজি প্রতি মোটা চাল কিনতে সকাল থেকে দীর্ঘ লাইন। সমাজের মধ্য বিত্তরাও দাড়িয়েছে লাইনে দাঁড়িয়ে মোটা চাল সংগ্রহে। এদিকে সম্প্রতি বয়ে যাওয়া, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে ৮০ হাজার ৭৭৭ হেক্টর জমির আমনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই ঘূর্ণিঝড়ে কৃষি খাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের মোট ৩১টি জেলার আমন ধানের আবাদি জমি নানা মাত্রায় আক্রান্ত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়ে আমনের মোট ৮০ হাজার ৭৭৭ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। এর বাইরেও বিপুল পরিমাণ আবাদি জমির ধানে চিটা পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে এবার আমন মৌসুমে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষি খাত সংশ্লিষ্টরা। এর ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবের ফলে এবার আমন চাষে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। বন্যা ও অনাবৃষ্টির কারণে কৃষক সময় মতো জমিতে আমন রোপণ করতে পারেননি। চলতি মৌসুমে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫৯ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমি। তবে চাষ হয়েছে ৫৬ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমি। এতে আমন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৫ লাখ টন কম হবে। এ অবস্থায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে আরও ৮১ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতি হওয়ায় উৎপাদন আরও ১০ লাখ টন কমে যাবে। সব মিলিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টন উৎপাদন কম হয়ে খাদ্য নিরাপত্তা চরম ঝুঁকিতে পড়বে

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, সিত্রাংয়ের আঘাতে কিছু জমি আক্রান্ত হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুবই কম। তারা বলছেন, উপকূলীয় এলাকাগুলোয় এবার দেরিতে ধান আবাদ করায় এখনো গাছগুলো ছোট। কিছু এলাকায় ধান হেলে পড়েছে। এর তথ্য আমরা নিচ্ছি। এতে সামান্য কিছু ক্ষতি হতে পারে। তবে সার্বিক উৎপাদনে এর প্রভাব পড়বে না। উল্টো ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে হওয়া বৃষ্টির কারণে তুলনামূলক ফলন ভালো পাওয়া যাবে।

সূত্র মতে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইল এ চার জেলায় এবার মোট ২ লাখ ৯৫ হাজার ৫৭০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ করা হয়। এর মধ্যে ২৩ হাজার ৭৭৭ হেক্টর জমি ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে খুলনা জেলার ধানি জমি। জেলাটিতে মোট ৯৩ হাজার ১৮৫ হেক্টর জমির মধ্যে ১৭ হাজার ৯৪২ হেক্টর আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া বাগেরহাটে আক্রান্ত হয়েছে ২১৩ হেক্টর জমির আমন ধান। চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাঁচ জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীতে এবার মোট ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৭৪২ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। শুধু আমন ধানেই চট্টগ্রাম অঞ্চলের কৃষকদের এবার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি টাকায় দাঁড়ানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অঞ্চলের ৭ হাজার ২০৮ কৃষক ক্ষতিগগ্রস্থ হয়েছেন। সাতক্ষীরাতে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে ১১৪ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ধরা হয়েছে ২ কোটি ৬৭ লাখেরও বেশি। সিত্রাংয়ের আঘাতে জেলার সাতটি উপজেলায় ৪ হাজার ৬২৫ জন কৃষকের ১১৪ দশমিক ৬ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে আমন ৮২ হেক্টর, সবজি ২২ দশমিক ৪ হেক্টর এবং সরিষা ১০ দশমিক ২ হেক্টর জমি। এসব ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ কোটি ৬৭ লাখ ৭২ হাজার টাকা।

সাধারণত উপকূলীয় তটরেখা বরাবর শতকরা ৮০ ভাগ সবুজ বেষ্টনী থাকতে হয়। বর্তমানে স্থানভেদে রয়েছে ২০ থেকে ৩০ ভাগ। অন্যদিকে, দেশে মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনাঞ্চল থাকা অপরিহার্য হলেও রয়েছে মাত্র ৮ থেকে ১০ ভাগ। বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে যেভাবে উজাড় করা হচ্ছে, তা এখন অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তো বটেই অতীতেও এই সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহ আঘাত ঠেকিয়ে দিয়েছে। নাকের ডগার সামনে নির্বিচারে উপকূলীয় বনাঞ্চল ও সবুজ বেষ্টনীর ধ্বংসযজ্ঞ চললেও তার বিরুদ্ধে যথা যথ ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
বিশেজ্ঞরা বলছে উপকূলীয় এলাকায় পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারসহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সুপেয় পানির টেকসই ও স্থায়ী সমাধান করতে হবে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আদলে উপকূলীয় এলাকায় একটি বাড়ি একটি সেল্টার কার্যক্রম শুরু করতে হবে। নদীভাঙন ও ভূমিক্ষয় ঠেকাতে উপকূলে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ ও সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। উপকূলের রক্ষাকবচ সুন্দরবন রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নতুবা খাদ্য নিরাপত্তায় মৃত্যু মুখে পড়বে লাখ মানুষ।

 

Check Also

সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।