সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি, প্রতারক এরতেজা যেন আরেক সাহেদ করিম

প্রতারণা ও জালিয়াতি ও ক্ষমতার দাপটে অন্যের জমি-বাড়ি জবরদখল ও অবৈধ ব্যবসা করে তিনি শত কোটি টাকার মালিক বনেছেন। ঢুকে পড়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইতে।

এছাড়াও পত্রিকার মালিক-সম্পাদক বনে সেটিকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে নানা অপকর্মের পাশাপাশি সাংবাদিক নির্যাতন করছেন এই এরতেজা।

ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, মুখোশধারী এরতেজা মূলত একজন বড় মাপের প্রতারক, জালিয়াত ও বাটপার। রাজনৈতিকভাবে অন্য মতাদর্শের হয়েও নিজ স্বার্থে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সম্পর্ক রেখে নিজের ভাগ্য গড়েছেন। সে যেন আরেক শাহেদ করিম, যিনি করোনা সংকটের শুরুতে চিকিৎসার নামে ভয়াবহ বাণিজ্য করে মহাপ্রতারক হিসেবে ধরা খেয়েছেন।

একইভাবে দীর্ঘদিন ধরে জালিয়াতি ও প্রতারণা করে আসা এরতেজা অবশেষে আশিয়ান গ্রুপের একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিন বিয়ে করা এই মুখোশধারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি ও ভুয়া ডক্টরের ডিগ্রি নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। তাকে কারাগারে আটকে রেখে তার যাবতীয় অপকর্ম ও সম্পদের উৎস সম্পর্কে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা।

রাজধানীর দক্ষিণখানের কাওলা এলাকায় আশিয়ান গ্রুপের মালিকানাধীন আশিয়ান সিটির ৫০ কোটি টাকা মূল্যের পাঁচ বিঘা জমির দলিল জালিয়াতি ও প্রতারণা মামলায় এরতেজা হাসানকে একদিনের রিমান্ডে নিয়েছে মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআই।

আসামিকে বুধবার ঢাকার হাকিম আদালতে হাজির করে দুই দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক মেহেদী হাসান। শুনানি শেষে মহানগর হাকিম মোশাররফ হোসেন আসামিকে একদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। শেষ বিকাল থেকেই পিবিআই কল্যাণপুর কার্যালয় রেখে এরতেজাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। এর আগে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে গুলশান-২ নম্বরের ৪৪ নম্বর সড়কের ৬/বি বাড়ি থেকে এরতেজাকে গ্রেপ্তার করে পিবিআইরের একটি দল। পরে কল্যাণপুর কার্যালয় নিয়ে রাতভর জেরা করা হয়

 

বেসরকারি নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ আব্দুল্লাহর সহযোগী হয়ে আশিয়ান গ্রুপের সঙ্গে জমির দলিল জালিয়াতি ও প্রতারণাসহ নানা অপকর্ম সম্পর্কে আসামিকে জেরা করেন পিবিআইয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এর বাইরে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম ভাঙ্গিয়ে আড়ালে নানা অপরাধে জড়ানোর বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব ঘটনায় বিতর্কিত ব্যবসায়ী এরতেজার বিরুদ্ধে আরও একাধিক মামলা হতে পারে বলে গোয়েন্দা সূত্র জানায়।

ভুক্তভোগী সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ভাটারা থানাধীন জগন্নাথপুরের ৪/বি পাঁচতলা বাড়ির মালিক সাইদুর রহমান ও শফিুল ইসলাম। কয়েক বছর আগে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এই বাড়িটি দখল করে নেন এরতেজা হাসান। সেখানে তার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী সেলিনা আক্তার নিয়ে বসবাস করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েও কোনো সুফল পাননি ভুক্তভোগীরা। ক্ষমতাসীন ও প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি দেখিয়ে ও যোগাযোগের কথা দাবি করে এসব কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। কথিত সাংবাদিক ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী এরতেজার বিরুদ্ধে এমন বাড়ি ও জমি দখলের আরও অভিযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কাজী এরতেজা হাসানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ করেছেন তার মালিকানাধীন পত্রিকাটি থেকে প্রতারিত সংবাদকর্মীরা। সংবাদকর্মীরা বলেন, এই ব্যক্তি সংবাদপত্র শিল্পকে কলুষিত করেছে। অনেক সংবাদকর্মীকে বেতনের খাতায় স্বাক্ষর নিয়ে তাদের বেতন না দিয়ে অফিস থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি ও তার পালিত সন্ত্রাসীরা। বেতন ও বকেয়া চাওয়ায় শামীম হাওলাদার নামে এক সাংবাদিককে কয়েক বছর আগে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়েছেন এই এরতেজা। এ ধরনের আরও অভিযোগ রয়েছে। তার রয়েছে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী।

সর্বশেষ রাজধানীর দক্ষিণখানের কাওলায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের পাঁচ বিঘা জমির দলিল জালিয়াতি ও প্রতারণা মামলার তদন্তে উঠে আসে কাজী এরতেজা হাসানের নাম। এ মামলার এজহারভুক্ত তিন আসামির মধ্যে ১ নম্বর ব্যক্তি হলেন জালিয়াতি ও প্রতারণার মূলহোতা নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ আব্দুল্লাহ। অন্য দুইজন হলেন রিয়াজুল আলম ও সেলিম মুন্সী।

এই মামলায় এর আগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন আরেক মুখোশধারী আবু ইউসুফ আব্দুল্লাহ। চলতি বছরের প্রথম দিকে বনানী থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে তদন্ত সংস্থা পিবিআইর স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ উত্তর। আশিয়ান গ্রুপের মালিকের স্বাক্ষর জাল করে সম্পূর্ণ বেআইনি প্রক্রিয়ায় ওই সময় জমির রেজিস্ট্রি নেয় নর্দান ইউনিভার্সিটি। আর এই প্রতারণা ও জালিয়াতিতে সহযোগী হিসেবে সহায়তা করেন ব্যাপক সমালোচিত ব্যবসায়ী কাজী এরতেজা হাসান।

গত ১০ জানুয়ারি জমি কিনতে গিয়ে দলিল জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে তিনজনকে আসামি করে খিলক্ষেত থানায় একটি মামলা দায়ের করেন আশিয়ান ল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) সাইফুল ইসলাম ভূইয়া। মামলায় আসামি করা হয় নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, রিয়াজুল আলম ও সেলিম মুন্সিসহ অজ্ঞাতনামা আরও সাতজনকে। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে পিবিআই। তাদের তদন্তে দলিল জালিয়াতি ও প্রতারণার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এরপর নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এই তথ্য জানিয়ে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে কাজী এরতেজা হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই মামলাটির অভিযোগপত্র এই মাসের মধ্যে দেয়া হবে।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জমি কেনার লক্ষ্যে রাজধানীর দক্ষিণখানের কাওলা এলাকায় আশিয়ান ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে ৫ বিঘা জমি পছন্দ করেন নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ এবং তার পরিচিত কাজী শামীম মাহদীনসহ কয়েকজন। সরাসরি জমি দেখে ২০১৩ সালের ৩ আগস্ট ৩০০ টাকার নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে লিখিতভাবে ৫০ কোটি টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হয়। চুক্তিপত্রে প্রথম পক্ষ হিসেবে আবু ইউসুফ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ জমির ক্রেতা এবং দুই নম্বর বিবাদী আসামি রিয়াজুল ইসলাম এতে স্বাক্ষর করেন। জমির দামের সম্পূর্ণ টাকা ২০১৩ সালের ৩০ আগস্টের মধ্যে পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতার কথাও চুক্তিপত্রে উলে­খ করা হয়।

সেই সময় মোট মূল্যের ৫০ কোটি টাকার মধ্যে নগদ চেকে ৩০ কোটি টাকা পরিশোধ করে অবশিষ্ট ২০ কোটি টাকা বাকি রাখা হয়। আশিয়ান ল্যান্ড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টকে সে সময় জানানো হয়, কাজ শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই বাকি টাকা পরিশোধ করে দেয়া হবে। ২০১৩ থেকে ১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও বাকি টাকা পরিশোধ করা হয়নি।

পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ চলমান থাকা অবস্থায় জমি বিক্রির পাওনা টাকা নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর কাছে চাইতে গেলে বলা হয়, কোনো টাকা পাওনা নেই। কারণ, আশিয়ান গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ভূইয়া ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে জমি রেজিস্ট্রেশন করে দিয়েছেন এবং তারা জমির দাম সম্পূর্ণ পরিশোধ করেছেন।

উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম ভূইয়া তার বড় ভাই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ভূইয়ার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে তিনি বিস্মিত হন, জমি রেজিস্ট্রির বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলেও তাকে জানিয়ে দেন। পরবর্তীতে ইউসুফ আব্দুল্লাহ টাকা পরিশোধ করার জন্য তাগাদা দিতে থাকেন তারা।

এজহারে আরও জানানো হয়, মামলার এক নম্বর আসামি ইউসুফ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ যে জমি কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন, সে জমি সাফ কাবলা দলিল নম্বর ১১৩৫৩ ২০১৩/১৫/১২ মূলে রেজিস্ট্রি হয় এবং জমির মূল্য ৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা দেখানো হয়। দলিলটি কমিশন নিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। সে দলিল সম্পাদনকারী হিসেবে বাদীর অফিসের মোহরার (দলিল সংক্রান্ত কাজকর্ম করেন যিনি) মো. শহিদুল ইসলামের নাম ব্যবহার করা হয়। এ বিষয়টি শহিদুলকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি দলিল লেখার কোনো কাজ করেননি বলে তথ্য দেন।

এজাহারে আরও উলে­খ করেছেন, দলিল সম্পর্কে মামলার দুই নম্বর ও তিন নম্বর আসামির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, নর্দান কর্তৃপক্ষ টাকা পরিশোধ করেই আপনার জমি রেজিস্ট্রি করিয়েছে। নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে বলা হয় বাদীকে। তাকে বিভিন্ন সময়ে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়া হয়। নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বাদী সাইফুল ইসলাম ভূইয়ার বড় ভাই আশিয়ান গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ভূইয়ার স্বাক্ষর, অফিসের সিল ও মোহরার মো. শফিকুল ইসলামের স্বাক্ষর জাল করে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে জমির দলিল রেজিস্ট্রেশন করে। এজাহারভুক্ত তিন আসামি ছাড়াও বিতর্কিত ব্যবাসায়ী এরতেজা হাসানসহ একটি চক্র প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গ করে জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে বলে পুলিশি তদন্তে উঠে আসে।

পিবিআই জানায়, জমি কিনতে গিয়ে আবু ইউসুফ আব্দুল্লাহ ও কাজী এরতেজা হাসান অন্যদের সহায়তায় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। এক ব্যক্তির পরিচয় দিয়ে অন্য ব্যক্তির মাধ্যমে তারা কাগজপত্র করিয়েছিলেন। মামলার তদন্তে জালিয়াতির বিষয়টি উঠে আসায় সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে কাজী এরতেজাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা দুইজন মিলে একটি চক্র হয়ে জমি কেনার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জমি নিজেদের দখলে নেয়ার পাঁয়তারা করছিলেন বলে জানা যায়।

মানবকণ্ঠ। ৩/১১/২২ প্রকাশিত রিপোট।

এই রিপোট ক্রাইমবাতার নহে।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।