বরিশালে গণসমাবেশ সাফল্যের নেপথ্যে অংশ নেন বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ

বাধার কারণেই সফল হয়েছে বিএনপির বরিশাল বিভাগীয় গণসমাবেশ-এমনটাই বলছেন দলটির নেতাকর্মীরা। লোকজন আসা ঠেকাতে নানা আয়োজনের খবর ছড়িয়ে পড়লে ‘যেভাবেই হোক সমাবেশে যেতে হবে’-এরকম একটা চ্যালেঞ্জ কাজ করে কর্মীদের মধ্যে। সেই চ্যালেঞ্জই সব বাধা পেরিয়ে মাঠে নিয়ে আসে তাদের। এই গণসমাবেশের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষের উপস্থিতি। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও বরিশালের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এরা এসে যোগ দেন শনিবারের জমায়েতে। তবে কিছু ঘটনা প্রশ্নের মুখেও ফেলেছে এ সমাবেশকে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদসহ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে সমাবেশ আয়োজনের কথা বলা হলেও সমাবেশ মাঠে কতিপয় নেতা তাদের ব্যক্তিগত প্রচার নিয়ে এতটাই বাড়াবাড়ি করেন যে প্রকারান্তরে তা গণসমাবেশের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বাধায় বেড়েছে জনসমাগম : বঙ্গবন্ধু উদ্যানের (বেলস পার্ক) মতো বিশাল মাঠে সমাবেশের আয়োজন কতটা সফল হবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল। কারণ এতবড় মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ করা ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপস্থিতি ছাড়া এই মাঠ গণজমায়েতের জন্য ব্যবহারের সাহস এর আগে আর কখনোই পায়নি কোনো রাজনৈতিক দল। ফলে সবাই ধরেই নেয় যে পুরো মাঠ পরিপূর্ণ করা সম্ভব হবে না বিএনপির পক্ষে। কিন্তু সেসব ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে সমাবেশের ২ দিন আগেই পূর্ণ হয়ে যায় মাঠের অর্ধেকের বেশি জায়গা। শুক্রবার নাগাদ আর পা-ফেলার জায়গা ছিল না মাঠে। আর শনিবার গণসমাবেশের দিন মাঠ উপচে চারদিকে দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা ছিল লোকে লোকারণ্য।

বরিশাল জেলা (দক্ষিণ) বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান নান্টু বলেন, ‘এই সাফল্যের জন্য ক্ষমতাসীন দলকে ধন্যবাদ দিতেই পারি। জমায়েত বানচাল করতে তারা যখন সমাবেশের আগের দিন থেকে বাস-লঞ্চসহ সব ধরনের গণপরিবহণ বন্ধের আয়োজন করল, তখনই বুঝে গেছি এটা গণসমুদ্রে পরিণত হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নেতাকর্মীরা বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নেওয়ায় লোক আসা শুরু হয় বৃহস্পতিবার থেকেই। পরিবহণ বন্ধ থাকার ঝক্কি এড়াতে সঙ্গে করে হাঁড়ি-পাতিল আর রান্নার সরঞ্জামাদিও নিয়ে আসেন তারা। আওয়ামী লীগের কারণেই ১ দিনের জমায়েত ৩ দিনের সমাবেশে রূপ নেয়।’

বৃহস্পতিবার দুপুরে সমাবেশ মাঠে এসে পৌঁছানো পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বাসিন্দা ফরহাদ মোল্লা বলেন, ‘বাস-লঞ্চ ধর্মঘট না ডাকলে শনিবার সকালে আসতাম বরিশালে। সমাবেশ শেষে আবার সন্ধ্যায় চলে যেতাম। এরা (আওয়ামী লীগ) যখন আমাদের আসা ঠেকাতে চাইল তখন একটা জেদ উঠে ভেতরে। কিভাবে ঠেকায় দেখব ভেবে বৃহস্পতিবারই চলে আসি।’ সমাবেশ মাঠে যতজনের সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের প্রায় সবার মধ্যেই দেখা গেছে এই জেদ।

সাধারণ মানুষের উপস্থিতি : বিএনপির এই গণসমাবেশে সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় ছিল সাধারণ মানুষের উপস্থিতি। কোনো রকম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না এমন অনেকে এসেছিলেন সমাবেশে। পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলার বাসিন্দা মঞ্জুরুল ইসলাম বসেছিলেন বঙ্গবন্ধু উদ্যানের দক্ষিণ-পূর্ব কর্নারে গাছের নিচে। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন বিছানার চাদর। মাথার নিচে ব্যাগ দিয়ে ঘুমিয়েছেন বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার রাতে। কেন এসেছেন জানতে চাইলে বললেন, ‘নাইটগার্ডের চাকরি করি। বাজারের সবাই মিলে চাঁদা তুলে ৮-৯ হাজার টাকা দেন। মাস দুই আগেও এ টাকায় কোনোমতে চলতে পেরেছি। কিন্তু এখন আর পারছি না। বাজারে আটা, চিনি আর ডাল ঠিকমতো পাচ্ছি না। যাওবা পাচ্ছি তার দাম আকাশছোঁয়া। সবশেষ কবে গরুর মাংস খেয়েছি মনে নেই। ইলিশ মাছে তো হাতই দিতে পারি না। চাল-ডাল, তেল-পেঁয়াজ কিনতে কিনতেই শেষ হয়ে যায় বেতনের ক’টা টাকা। সমাবেশে এসেছি নেতাদের কথা শুনতে। এরা তো আমাদের জন্য আন্দোলন করছে। যদি কিছু হয়।’

গণসমাবেশের প্রধান সমন্বয়কারী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এটাই গণসমাবেশের বড় সাফল্য। সাধারণ মনুষের জন্য এ আন্দোলনে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষের উপস্থিতিই প্রমাণ করে আমরা সঠিক পথে আছি।’

আত্মপ্রচার, উপেক্ষিত গণসমাবেশের এজেন্ডা : এই গণসমাবেশে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিকটু ছিল বিভিন্ন এলাকার নেতাদের নিজস্ব প্রচার নিয়ে ব্যস্ততা। অসাংগঠনিক এ আচরণের কারণে গণসমাবেশের দিনেও মাঠে সৃষ্টি হয় চরম বিশৃঙ্খলা। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে মাঠে আসতে শুরু করেন বিভিন্ন এলাকার নেতাকর্মীরা। মাঠের চারদিকে তাঁবু করে অবস্থান শুরু করেন তারা। শুক্রবার থেকে শুরু হয় নেতাদের নেতৃত্বে সমর্থকদের আসা। আর সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রচারণা। অমুক ভাই তমুক ভাইয়ের নামে স্লোগানে চাপা পড়তে থাকে গণসমাবেশ আয়োজনের মূল এজেন্ডা। এ যন্ত্রণা চলে সমাবেশের শেষ পর্যন্ত। শনিবার সকাল থেকে মাঠে আসা সব মিছিলেরই স্লোগান ছিল নেতাদের জয়গানকেন্দ্রিক। বেলা ১১টায় জনসমাবেশ শুরুর পরও চলতে থাকে এমন আচরণ। বিভিন্ন এলাকায় দলীয় মনোনয়ন প্রার্থীদের পক্ষে হয় এ ধরনের কর্মকাণ্ড। দুপুরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম যখন সমাবেশস্থলে আসেন তখনও অনেকেই মাঠে না এসে আশপাশের সড়কগুলোতে মিছিল করে স্লোগান দিচ্ছিলেন নিজ নিজ নেতার পক্ষে। যে কারণে মাঠের অর্ধেক তখনও ছিল ফাঁকা। জনসমাবেশের শেষ পর্যায়ে তারা মাঠে প্রবেশ করেন। নেতাদের নামের স্লোগান থামানো আর তাদের টানানো ফেস্টুন নামাতে বারবার মাইকে ঘোষণা দিতে থাকেন মঞ্চের নেতারা। এছাড়া মাঠের চারপাশে যত ব্যানার-ফেস্টুন লাগানো হয় সেগুলোতেও দলের এজেন্ডা না দিয়ে নিজেদের ছবি আর সমর্থনেরই জানান দেন আত্মপ্রচারে ব্যস্ত থাকা নেতারা। স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান বলেন, ‘এটা আসলেই আমাদের ব্যর্থতা। এমন অনেক নেতা আছেন যাদের আন্দোলন-সংগ্রামে খুঁজে পাওয়া না গেলেও মনোনয়ন প্রশ্নে জীবন বাজি রেখে নামেন। এরা যদি আন্দোলন-সংগ্রামে এরকম জানবাজি রাখতেন তাহলে আরও অনেক আগেই এ ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটত। আজকের এ গণসমাবেশে যোগ দিয়েছেন অনেক সাধারণ মানুষ। আমাদের মিছিল-স্লোগানে যদি শুধু তাদের কথাই থাকত তবে সাধারণ মানুষের এই যে সমর্থন তার মূল্য দেওয়া হতো।

‘৫ শতাধিক নেতাকর্মী আহত’ : বরিশালে গণসমাবেশে অংশ নিতে গিয়ে ৫ শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন দলটির নেতারা। সড়ক পথে গৌরনদী-আগৈলঝাড়ায় দলের কেন্দ্রীয় নেতারা পর্যন্ত হামলার শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের। রোববার বরিশালে এক সংবাদ সম্মেলনে গণসমাবেশ বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ও কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন এ তথ্য দেন। তবে আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির এসব অভিযোগকে স্ট্যান্টবাজি আখ্যা দিয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির দল নেতা হাবিবুন নবী সোহেল বলেন, নলছিটিতে তাদের নেতাকর্মীদের দোকান ও বাড়িতে হামলা করেছে আওয়ামী লীগের লোকজন। বাকেরগঞ্জে জনসভায় আসার সময় ৫০ জন আহত হয়েছেন। বরগুনার আমতলীতে গাড়িবহরে হামলা হয়েছে। দৌলতখান, লালমোহনে নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হয়েছেন। ভোলায় গুলিবর্ষণও করা হয়েছে। গৌরনদীতে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলের গাড়িতে হামলা হয়েছে। হামলার শিকার হয়েছেন বানারীপাড়া, উজিরপুরের নেতাকর্মীও।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন-বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক, সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির, সাবেক এমপি মেজবাউদ্দিন ফরহাদ প্রমুখ।

Check Also

সাতক্ষীরা আলিয়া কামিল মাদ্রাসার হিফজুল কুরআন বিভাগের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা, দস্তরবন্দি, সম্মাননা প্রদান ও মিলন মেলা অনুষ্ঠিত

আব্দুল করিম,নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরা আলিয়া কামিল মাদ্রাসার হিফজুল কুরআন বিভাগের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।