উপকূল দিবস আজ

প্রকাশ ঘোষ বিধান:  আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর। উপকূলবাসীর কাছে এক ভয়াবহ কালরাত হিসেবে বিবেচিত। ১৯৭০ সালের এইদিনে বাংলাদেশের উপকূলে প্রবল শক্তি নিয়ে আঘাত করেছিল ‘ভোলা সাইক্লোন’। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। উপকূলীয় দ্বীপচরসহ বহু এলাকার ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে বিরান জনপদে পরিণত হয়। এখনও উপকূলের মাটি ও মানুষের মাঝে মিশে আছে শোকগাঁথা। এই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতায় আজও অনেকে শিউরে ওঠেন। সেই দিনের ধ্বংসের ধারাবাহিকতা বিরাজ করছে আজও। সেই প্রলয়ের স্বাক্ষী হয়ে আছেন উপকূলের প্রবীণ মানুষেরা।
ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে ভোলা এবং তৎকালীন নোয়াখালী (নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর) উপকূলে। তজুমুদ্দিন উপজেলায় ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে বেঁচে ছিল মাত্র ৭৭ হাজার। মনপুরা দ্বীপের ৩২ হাজার মানুষের মধ্যে ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা, পটুয়াখালী, খুলনা ও সাতক্ষীরা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। সাগর-নদী-খাল-বিলে ভেসে ছিল অসংখ্য লাশ। মৃতদেহের সৎকার করাও সম্ভব হয়নি। উপকূলের লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি, স্বজন হারিয়ে পথে বসেন। আজকের মতো যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না থাকায় ওই সময়ে মানুষ আবহাওয়ার পূর্বাভাসও সঠিকভাবে পায়নি। তাই সেদিন ছিল না কোন পূর্ব প্রস্তুতি।

জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডবি¬উএমও) এ ঘূর্ণিঝড়কে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উলে¬খ করেছে। এই ঝড় কে ‘ভোলা সাইক্লোন’ও বলা হয়। ১২ নভে¤¦রের ঘটনা উপকূলবাসী আজও ভুলেনি। এটাই উপকূলবাসীর কাছে একটি স্মরণীয় দিন। কারণ, ১৯৭০ সালের এই দিনে উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল পুরো উপকূল। এ পর্যন্ত ইউকিপিডিয়ার রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ এবং এটি সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকরতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এটি ১৯৭০ সালের উত্তর ভারতীয় ঘূর্ণিঝড় মৌসুমের ষষ্ঠ ঘূর্ণিঝড় এবং মৌসুমের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ছিল। এটি সিম্পসন স্কেলে ‘ক্যাটাগরি ৩’ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। ঘূর্ণিঝড়টি বঙ্গোপসাগরে ৮ নভেম্বর সৃষ্টি হয়ে ক্রমেই শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তরদিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এটির গতিবেগ সর্বোচ্চে পৌঁছায় আর ১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। ১৫ থেকে ২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপগুলো প-াবিত হয়। এ ঘূর্ণিঝড় গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এছাড়া দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও এ ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপক প্রভাব পড়ে।

ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস, জোয়ার-ভাটার বিস্তৃতি ও লবণাক্ততার প্রভাব এ তিনটি নির্দেশকের আওতাভুক্ত উপকূলীয় ১৯টি জেলা। এর মধ্যে ১৬ জেলা প্রত্যক্ষভাবে উপকূলবর্তী। এগুলো হল পূর্ব উপকূলের ৬ জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর মধ্য উপকূলের ৭ জেলা ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, শরীয়তপুর এবং পশ্চিম উপকূলের ৩ জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। বাকি ৩ জেলা অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ এগুলো হচ্ছে যশোর, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ। টেকনাফের নাফ নদের মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল কালিন্দী পর্যন্ত উপকূল অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার বেলাভূমি। দেশের ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলের মোট ১৯টি উপকূলীয় জেলা ও ১৪৭টি উপজেলার মধ্যে ১২টি জেলার ৪৮টি উপজেলা সমুদ্রের অববাহিকায় অবস্থিত। বাকি ৯৯টি উপজেলা ভৌগোলিকভাবে অভ্যন্তরীণ উপকূলের অংশ।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ বাস করে উপকূলীয় অঞ্চলে। এদের জীবন-জীবিকা প্রাথমিকভাবে নির্ভর করে মাছ, কৃষি, বন, স্থানীয় পরিবহন, লবণ ইত্যাদির ওপর। এ দেশের উপকূলের জনগোষ্ঠী প্রতি বছর নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদির মুখোমুখি হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানবসৃষ্ট নানা রকম দুর্যোগ। আর এসবের সঙ্গে সংগ্রাম করেই বেঁচে আছে এ অঞ্চলের মানুষ। এসব উপকূলজুড়ে যেমন রয়েছে নানা সমস্যা তেমনি রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বিপুলসংখ্যক মৎস্যজীবী সমুদ্র-নদীতে মাছ ধরে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। সেই আহরিত মাছ জাতীয় অর্থনীতির বড় অংশীদার। জাতীয় অর্থনীতিতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল জিডিপিতে কম-বেশি প্রায় ২৫ শতাংশ অবদান রাখছে।

২০১৬ সালে পত্রিকায় উপকূল দিবসের দাবিতে লেখা প্রকাশ। ২০১৭ সাল থেকে উপকূলীয় জেলা ও উপজেলায় ‘উপকূল দিবস’ পালন এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি করে আসছে। কোস্টাল জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ এর পাশাপাশি অন্যান্য সংগঠনও এ দাবির পক্ষে সোচ্চার রয়েছে।
উপকূলের সমস্যা, সম্ভাবনা এবং মানুষের অধিকার ও ন্যায্যতার দাবি তুলে ধরতে উপকূলের জন্য একটি বিশেষ দিন অপরিহার্য। ইতিহাস থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়, দিবস থেকে মানুষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং দিবসের কথা স্মরণে রাখে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর মনে রাখার মতো একটি দিন। তাই কোস্টাল জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চায়। ঘূর্ণিঝড় এলেই প্রচার মাধ্যমের উপকূলের দিকে চোখ পড়ে। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে উপকূলে জীবনযাপন কতটা অস্বাভাবিক, তা গণমাধ্যমের দৃষ্টিতে আসে না। এ জন্য ভোলা সাইক্লোনসবিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ে নিহতদের স্মরণ, দুর্যোগ মোকাবিলায় মানুষদের সচেতন, উপকূলের সমস্যা আর সম্ভাবনাকে প্রকাশের জন্য ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ পালন করা। দেশে ২০১৭ সাল থেকে উপকূল দিবসের দাবি তুলছেন কোস্টাল জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ, উপকূল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন, কোস্টাল ইয়ুথ নেটওয়ার্ক, আলোকযাত্রা, বনবিবি, নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ প্রায় ১০০টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটি’।

উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমুখী দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করেন। ঝড়-ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এক জনপদ উপকূল। বৈরী প্রতিকূলতা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততার প্রভাব প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে উপকূলের শ্রমজীবী মানুষকে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের পাঁচ দশক পার হয়েছে। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের স্মরণে ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এই দিনটি ‘ওয়ার্ল্ড কোস্টাল ডে’ হওয়া উচিত। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের উপকূলের নতুন নতুন দুর্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলতেও একটি দিবসের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। উপকূলের উন্নয়ন, সংকটের উত্তরণ, সম্ভাবনা আলোয় আনতে ‘উপকূল দিবস’ প্রবর্তন এখন সময়ের দাবি। সরকার উপকূলের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে ১২ নভেম্বরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে পালনের দাবি বাস্তবায়ন করবে। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Check Also

সাতক্ষীরা আলিয়া কামিল মাদ্রাসার হিফজুল কুরআন বিভাগের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা, দস্তরবন্দি, সম্মাননা প্রদান ও মিলন মেলা অনুষ্ঠিত

আব্দুল করিম,নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরা আলিয়া কামিল মাদ্রাসার হিফজুল কুরআন বিভাগের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।