আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: মূল্য হারানো সোনালি আঁশের পাটকাঠি চাষিদের নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে । পাটের চেয়ে পাটকাঠির তুলনা মূলক দাম বেশি পাচ্ছে চাষিরা। চলতি মৌসুমে শুধু সাতক্ষীরা জেলাতে কয়েক কোটি টাকার পাটকাঠি বেচা-কেনা হয়েছে। কারণ পাটকাঠি বা পাটখড়িকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ও যথাযথ প্রক্রিয়ায় পুড়িয়ে এরপর শীতলীকরণ ও সংকোচন করে চারকোল তৈরি করা হচ্ছে। এই চারকোলে প্রায় ৭৫ শতাংশ কার্বন থাকে। পানি বিশুদ্ধকরণ, আতশবাজি, জীবনরক্ষাকারী বিষনিরোধক ট্যাবলেট, প্রসাধনসামগ্রী, ফটোকপিয়ার ও কম্পিউটারের কালি তৈরির কাঁচামাল হিসেবে চারকোল ব্যবহার করা হচ্ছে দেশ বিদেশে। বর্তমানে ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মাগুরাসহ কয়েকটি জেলার প্রায় ৪০টি কারখানায় চারকোল উৎপাদিত হচ্ছে। এসব কারখানা থেকে বছরে প্রায় ৭ হাজার ৭১ মেট্রিক টন চারকোল বিদেশে রপ্তানি হয়, যার মাধ্যমে বছরে প্রায় ৪০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়।
পাটকাঠির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে দেশে বর্তমানে অন্তত ৩৩টি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে। বিশেজ্ঞরা বলছে, পাইরোলাইসিস পদ্ধতিতে পাটকাঠি পুড়িয়ে বেশি ঘনত্বের কয়লা তৈরি করা হয়, যেটির শোষণ ও রাসায়নিক সক্ষমতা অনেক বেশি। এ ধরনের কয়লাকে বাণিজ্যিকভাবে অ্যাকটিভেটেড কার্বন বা চারকোল বলা হয়। প্রতি তিন কেজি পাটকাঠি থেকে এক কেজি কার্বন তথা চারকোল পাওয়া যায় পাটকাঠির কয়লা থেকে তৈরি চারকোল মুঠোফোনের ব্যাটারি, বুলেটের বারুদ, প্রসাধনী, প্রিন্টারের কালি তৈরি, পানি শোধনের ফিল্টার, কৃষিজমির উর্বরতাশক্তি বাড়ানোসহ ৫২টি বেশি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রতি টন চারকোলের দাম ৭৫০ ডলার, যা বাংলাদেশের প্রায় ৬৪ হাজার ৫০০ টাকার সমান (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ধরে)।
কানাডাভিত্তিক আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান অ্যালাইড মার্কেট রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী চলতি ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে চারকোলের চাহিদা দাঁড়াতে পারে ২৭ লাখ ৭৬ হাজার টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০০ কোটি ডলার।
সম্প্রতি ব্যাপক পরিসরে পাটকাঠি থেকে অ্যাকটিভেটেড চারকোল উৎপাদন শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে বদলে যাবে পাটশিল্পের অবস্থান। পাট থেকে খুলবে সম্ভাবনার দ্বার। দেশের মোট উৎপাদিত পাটকাঠির ৫০ ভাগ চারকোল উৎপাদন করে রপ্তানি করতে পারলে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিদেশি মুদ্রা অর্জন সম্ভব বলে জানান এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। তারা এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারের প্রওয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা চান।
দেশে ২০১২ সালে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে পাটকাঠি থেকে অ্যাকটিভেটেড চারকোল উৎপাদন শুরু হয়। ওই বছরই চীনে এ পণ্য রপ্তানি হয়। ১০ বছর আগে পাটকাঠিকে ছাই বানিয়ে তা রপ্তানির পথ দেখান ওয়াং ফেই নামের চীনের এক নাগরিক। বর্তমানে চীন ছাড়াও তাইওয়ান, জাপান, হংকং ও ব্রাজিলেও এটির চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া চারকোলের বড় বাজার রয়েছে মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানিসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে।
দেশে একে একে বহু পাটকল বন্ধ হওয়ায় এবং প্লাস্টিক পণ্যের দাপটে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার কমে যাওয়ায় মাঝে পাট উৎপাদনে ভাটা পড়েছিল। এখন পাটপণ্যে কিছুটা হলেও বৈচিত্র্য আসায় এবং পাটকাঠির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় দেশে আবারও পাটের উৎপাদন বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে পাটখড়ি থেকে উৎপাদিত চারকোলের রপ্তানি বাড়াতে চারকোল নীতিমালা করেছে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রণালয়। এতে চারকোলশিল্পের জন্য দক্ষ জনবল তৈরি, রপ্তানিতে সরকারি প্রণোদনা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, চারকোলশিল্পের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা দূর করার কথা বলা হয়েছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পরিবেশবান্ধব, টেকসই, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও রপ্তানিমুখী চারকোলশিল্প প্রতিষ্ঠায় ‘চারকোল নীতিমালা- ২০২২’ প্রণয়ন করেছে সরকার। নীতিমালায় বলা হয়েছে, পাটখড়ি থেকে অত্যন্ত কম মাত্রায় কার্বন নিঃসরণ হয় বলে চারকোলশিল্পকে পরিবেশবান্ধব মনে করা হয়। তাই পাটখড়িসহ অন্য যেকোনো উপকরণ থেকে চারকোল উৎপাদন ও এ খাতের শিল্পসমূহকে বিকশিত করার লক্ষ্যে জাতীয় স্বার্থে নীতিমালাটি করা হয়েছে। প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের চারকোল উৎপাদন, বিপণন ও রপ্তানি বিষয়ে সহায়তা প্রদান, দক্ষ জনবল তৈরি, উৎপাদিত চারকোলের মান নিয়ন্ত্রণ, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে সহযোগিতা প্রদান, দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে সুযোগ সম্প্রসারণ ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোসুবিধা প্রদান এবং চারকোল রপ্তানিতে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনা প্রদানও এ নীতিমালার উদ্দেশ্য। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রণালয়ের প্রত্যাশা, নতুন এ নীতিমালা তৈরির ফলে চারকোলশিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোসুবিধা ও সরকারি প্রণোদনার সুযোগ বাড়বে। এর ফলে চারকোলের উৎপাদন, রপ্তানি ও রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়বে। এ ছাড়া প্রায় ২০ হাজার লোকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, পাট অধিদপ্তর সরকারের পক্ষে এ নীতিমালা বাস্তবায়ন, তদারকি, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করবে। এ ছাড়া চারকোলশিল্পে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপনসহ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যে জানা গিয়েছে, চলতি ২০২২ মৌসুমে সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলায় ১১ হাজার ৫৭৯ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদরে ৮২৫ হেক্টর, কলারোয়ায় ৩ হাজার ৫৫৫, তালায় ৩ হাজার ৫৫, দেবহাটায় ৩০, কালীগঞ্জে ২৫, আশাশুনিতে ৮৫ এবং শ্যামনগর উপজেলায় ৪ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১ হাজার হেক্টর কম আবাদ হয়েছে। সূত্রটি আরো জানায়, গত মৌসুমে জেলায় পাটের আবাদ হয়েছিল ১২ হাজার ৫২০ হেক্টর। জেলায় এবার দেড় লাখ বেল্ট পাট উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. জামাল উদ্দিন জানান, পাট একটি লাভজনক ফসল। তাছাড়া জেলার মাটি ও আবহাওয়ার কারণে ভালো উৎপাদনও সম্ভব। কিন্তু পাট রফতানি চাহিদা যদি ভালো না হয় তাহলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবেন না। তার পরও লোকসান হওয়ার মতো ফসল এটি না। কিন্তু এবার চাষীদের খরচ একটু বেশি হয়েছে। তার কারণ হলো সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় তারা বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে পাট পচায়। তবে যেটুকু ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে লাহবান হবে পাঠকাঠি বিক্রি করে।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …