স্টাফ রিপোর্টার : ঢাকার আদালত এলাকায় ‘পুলিশের চোখে স্প্রে মেরে’ পালিয়ে গেছে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃতুদ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গী। গতকাল রোববার দুপুরে পুরান ঢাকার আদালত পাড়ায় এ ঘটনার পর পলাতক দুই আসামীর খোঁজে পুলিশ মাঠে নেমেছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। পালিয়ে যাওয়া ওই দুই আসামী হলেন: মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান এবং আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব।
কোতোয়ালি থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন, “বেলা ১২টার দিকে তারা পুলিশ হেফাজত থেকে পালিয়ে যায়। আমরা তাদেরকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।”
নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামের এ দুই সদস্য দীপন হত্যায় মৃতুদ-প্রাপ্ত আসামী। লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলাতেও আবু সিদ্দিক সোহেলের ফাঁসির রায় হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ কমিশনার মো. ফারুক হোগেণ বলেন, “তাদেরকে অন্য মামলার শুনানিতে হাজির করতে কাশিমপুর কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়েছিল। সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল থেকে নেওয়ার সময় পুলিশের চোখে স্প্রে জাতীয় কিছু মেরে তারা পালিয়ে যায় বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।”
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গণমাধ্যমকে বলেন, দুই জঙ্গী মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবকে তাদের সহযোগীরা ছিনিয়ে নিয়েছেন। একটি মামলায় শুনানি শেষে আদালত থেকে হাজতখানায় নেওয়ার পথে দুই জঙ্গীর সহযোগীরা হাজতখানা পুলিশের চোখে স্প্রে ছিটিয়ে, কিল-ঘুষি মেরে মইনুল হাসান শামীম ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেলকে ছিনিয়ে নেন। এরপর তারা দুটি মোটরসাইকেলে করে রায়সাহেব বাজার মোড়ের দিকে পালিয়ে যান।
মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামিরের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মাধবপুর গ্রামে। মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবের বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ভেটেশ্বর গ্রামে। তাদের ধরিয়ে দিতে পুলিশ একসময় পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল। মইনুল হাসান শামীম ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল একাধিক মামলার আসামী।
ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে দুই জঙ্গীর মামলার শুনানির দিন ধার্য ছিল গতকাল। ঢাকার সিজেএম আদালতের অষ্টম তলায় ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি গোলাম সারোয়ার খান বলেন, ‘আদালতে শুনানি শেষে এই দুজনকে হাজতখানায় নেওয়ার পথে তাদের ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
এদিকে ঘটনাস্থলে ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশসহ বিভিন্ন বিভাগের সদস্যরা হাজির হয়েছেন। সোয়াত টিমের সদস্যরাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, ছিনিয়ে নেওয়া জঙ্গীদের ধরতে অভিযান চলবে।
পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গী প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামী মইনুল হাসান শামীম ও আবু সিদ্দিক সোহেল। ধরিয়ে দিলে প্রত্যেকের জন্য ১০ লাখ টাকা করে ২০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেছে পুলিশ।
এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। রোববার (২০ নবেম্বর) দুপুরে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান।
সারাদেশে আদালতে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ: ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ‘পুলিশের চোখে স্প্রে মেরে’ মৃতুদ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গীর পালিয়ে যাওয়ার খবর প্রকাশের পর সারাদেশে আদালতগুলোতে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ নিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সর্বোচ্চ আদালত প্রশাগণ থেকে গতকাল রোববার দুপুরে অধস্তন আদালতগুলোতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মাদ সাইফুর রহমান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “সারাদেশের অধস্তন আদালতগুলোতে নিরাপত্তা জোরদারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা মৌখিকভাবে জানিয়েছে।”
ডিএমপির তদন্ত কমিটি : আদালত থেকে দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গীকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। গতকাল বিকেলে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের স্বাক্ষরিত এক আদেশে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারকে (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) সভাপতি করে গঠিত কমিটির বাকি চার সদস্য হলেন -ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন), যুগ্ম কমিশনার (সিটিটিসি), ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ও ডিএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (সিআরও)।
হাসপাতালে আহত পুলিশ কনস্টেবল : পুলিশের চোখে স্প্রে মেরে দুই আসামীকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় আহত কনস্টেবল নুরে আজাদকে চিকিৎসার জন্য জাতীয় চক্ষু হাসপাতাল আগারগাঁও পাঠানো হয়েছে। এর আগে তাকে ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
রাজধানীতে রেড অ্যালার্ট: মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট : ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে পুলিশের চোখে-মুখে স্প্রে ছিটিয়ে দুই জঙ্গী পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় রাজধানীতে রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়েছে পুলিশ।
রাজধানীর মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেন ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোগেণ। তিনি বলেন, ওই দুই জঙ্গী পুলিশকে স্প্রে করে আগে থেকে প্রস্তুত মোটরসাইকেল যোগে পালিয়ে যায়। তাদের ধরতে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে শুরু করে আশপাশের সব স্থানের সিসিটিভি ফুটেজ দেখা হচ্ছে।
এর আগে রাজধানীতে রেড অ্যালার্ট জারি করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। পালিয়ে যাওয়াদের ধরতে পুলিশের একাধিক ইউনিট মাঠে কাজ করছে।
ঘটনার পর থেকেই আদালত এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মোতায়েন করা হয়েছে বাড়তি পুলিশ। পুরো এলাকায় চালানো হয়েছে তল্লাশি। ডিবি পুলিশ, সোয়াট, র্যাব ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরাও দিনভর ছিল তৎপর। বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট-সোয়াট ও পুলিশের বিভিন্ন সাজোয়া যান মোতায়েন করা হয়। ঘটনার পরপরই পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আগেণ। ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামানসহ আরও ঊর্ধ্বতনরা বর্তমানে আদালত এলাকায় অবস্থান করছেন।