আবু সাইদ বিশ্বাস,ক্রাইমবাতা ডেস্ক রিপোট: তিন দশক ধরে যে স্বপ্ন দেখেছেন, সেই স্বপ্ন পূরণের মাইলফলকে পৌঁছে গেছেন মালয়েশিয়ার প্রবীণ রাজনীতিক আনোয়ার ইব্রাহিম। বৃহস্পতিবার দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার এই স্বপ্ন পূরণের যাত্রাপথ বন্ধুর নয়, বরং কণ্টকাকীর্ণ ছিল। কখনও রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন, কখনও কারাগারে গেছেন। এক মন্তব্যে তিনি বলেছিলেন, তিন দশক ধরে যে পদটিতে চোখ রাখছিলেন তিনি, সেই পদে যেতে তাকে প্রচণ্ড অধ্যবসায় করতে হয়েছে।
গত শনিবারের নির্বাচনের একদিন পর আনোয়ার ইব্রাহিম তার বাসভবনের বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলেন, আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছ থেকে একটি বিষয় শিখতে হবে— ধৈর্য, দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা এবং ধৈর্য।
ইতিহাসের এক নির্মম প্রতিশোধের দৃশ্য দেখলো বিশ্ববাসী। ঘটনাস্থল দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সমৃদ্ধ দেশ মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর।
আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে এই ব্যক্তি উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত হয়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন কারাগারের অন্ধকার কুঠরিতে। এবার তিনি এই শহরের ‘আসতানা নেগারা’ রাজপ্রাসাদে দেশটির দশম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদের হাতে অপদস্থ হয়েছিলেন আনোয়ার ইব্রাহিম। মাহাথিরের জোট গত ১৯ নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে। আর বিজয়ী হয়েছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে দক্ষিণ এশিয়ার ‘বিস্ময়’ মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে ২ জনের নাম বিশ্বের গণমাধ্যমে বেশি আলোচিত। তাদের একজন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ। অপরজন সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম।
আনোয়ার ইব্রাহিম ছিলেন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা ২ জন মিলেই গড়েছিলেন আধুনিক মালয়েশিয়া।
১৯৯০ এর দশকে বলা হতো—মাহাথিরের পরে দেশটির হাল ধরবেন আনোয়ার। সেসময় উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়াও তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯৯৮ সালে আচমকা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোয় আনোয়ার ইব্রাহিমের বরখাস্তের সংবাদ আসে। সমকামিতা ও দুর্নীতির অভিযোগে তার বিচার শুরু হয়। পরের বছর এপ্রিলে তার কারাদণ্ড হয়।
আনোয়ারের এই কারাদণ্ডের সমালোচনা করে বেশ কয়েকটি দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
প্রায় ২২ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন শেষে ড. মাহাথির মোহাম্মদ ২০০৩ সালে অবসর নিলে এর পরের বছর কারাবাস থেকে মুক্তি পান আনোয়ার ইব্রাহিম। এরপর শুরু হয় তার নতুন রাজনৈতিক জীবন। মাহাথিরের ক্ষমতাসীন বারিসান ন্যাসিওনালের (বিএন) বিরুদ্ধে জনমত গড়তে নিজেকে নিয়োজিত করেন। পরবর্তীতে মাহাথির বিএন ছেড়ে দেওয়ায় দলটিতে নেতৃত্ব সংকট দেখা দেয়।
এ দিকে, আনোয়ারের পরিশ্রম বৃথা যায়নি। ছোট ছোট দল নিয়ে পাকাতান হারাপান (পিএইচ) জোট গড়েন। জোটকে শক্তিশালী করে ২০০৮ সালে বিরোধীদলের নেতা হিসেবে মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন তিনি।
উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত হওয়ার প্রায় ২৫ বছর পর পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির মতো ভস্মস্তূপ থেকে আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলেন আনোয়ার ইব্রাহিম। এই দীর্ঘ সময় তিনি বিরোধীদলীয় রাজনীতিক ও আইনপ্রণেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আজ বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায় মন্তব্য করা হয়—প্রধানমন্ত্রীর এই পদ আনোয়ার ১৯৯০ এর দশকেই পেতে পারতেন।
গত ১৯ নভেম্বর দেশটির জাতীয় নির্বাচনে ২২২ আসনের পার্লামেন্টে আনোয়ার ইব্রাহিমের জোট সর্বোচ্চ ৮২ আসন জয় করে আলোচনায় আসে। নির্বাচনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের পেরিকাতান ন্যাসিওনাল (পিএন) জোট পেয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৩ আসন ও ক্ষমতাসীন জোট বারিসান ন্যাসিওনালের (বিএন) পেয়েছে ৩০ আসন। মাহাথিরের ‘গেরাকান তানাহ এয়ার’ জোটের হয়েছে ভরাডুবি।
সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় ১১২ আসন থেকে দূরে থাকায় সেখানে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। নির্বাচিত দল ও জোটগুলো ঐক্যমত্যের সরকার গঠনে ব্যর্থ হলে দেশটির প্রধান রাজা ও পেনাংয়ের সুলতান আবদুল্লাহ রিয়াতউদ্দিন আল মোস্তাফা বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত।
আঞ্চলিক রাজাদের সঙ্গে আজ স্থানীয় সময় সকালে বৈঠকের পর ঘোষণা আসে মালয়েশিয়ার দশম প্রধানমন্ত্রী হবেন আনোয়ার ইব্রাহিম।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বিজিএ মালয়েশিয়ার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আসরুল হাদি আবদুল্লাহ সানি সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, ‘আনোয়ারের জন্য এটা দীর্ঘ সময়। তার সংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য প্রচারণা এখন সফল হতে চলেছে।’
তাই এটা বলাই যায় যে, মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে আনোয়ার ইব্রাহিমের এই উত্থান ফিনিক্স পাখির জেগে ওঠার মতোই।