আগের হেফাজতের সঙ্গে বর্তমানে যে হেফাজত রয়েছে তার কোনো সম্পর্ক নেই: মুফতি ফয়জুল্লাহ

ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব ও দেশের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া কোরআনীয়া লালবাগের সহকারী পরিচালক মুফতি ফয়জুল্লাহ। দেশের ধর্মীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে এক আলোচিত নাম।

এদেশের বরেণ্য আলেম ও রাজনীতিক প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমীনির হাত ধরে রাজনীতিতে পথচলা শুরু মুফতি ফয়জুল্লার। মুফতি আমীনির মৃত্যুর পর তার সংগঠন ইসলামী ঐক্যজোটের প্রধান নেতায় পরিণত হন তিনি। ২০১২ সাল থেকে দলটির মহাসচিব হলেও মূলত ইসলামী ঐক্যজোটের শীর্ষ নেতা হিসেবেই পরিচিত গুণী এ রাজনীতিবীদ।

আলোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলামের প্রভাবশালীদের একজন ছিলেন সংগঠনটির প্রথম কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ। নানা ইস্যুতে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম রাখার পাশাপাশি টিভি টকশোতে নিয়মিত উপস্থিতি দেখা যায় তার। নেতাকর্মীরাও বেশ উজ্জীবিত হয় তার বক্তব্যে।

রাজনীতির পাশাপাশি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের সহ সভাপতি ও কওমি মাদ্রাসাগুলোর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আল হাইআতুল উলয়ার স্থায়ী কমিটির সদস্য মুফতি ফয়জুল্লাহ।

দেশের ইসলামপন্থি রাজনীতির হালচাল, আসন্ন নির্বাচন, হেফাজতে ইসলাম ও কওমি মাদ্রাসা বিষয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- তানজিল আমির

যুগান্তর: স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলো, এই দীর্ঘ সময়ে ইসলামপন্থিদের রাজনৈতিক বিভিন্ন কার্যক্রম ও সংগ্রাম হয়েছে। দীর্ঘ সময়েও ইসলামপন্থি রাজনীতির উত্থান না হওয়ার পেছনে কী কী কারণ বলে আপনি মনে করেন?

মুফতি ফয়জুল্লাহ: আমি প্রথমত এ কথায় বিশ্বাসী না যে, ইসলামপন্থিদের উত্থান হয়নি। বরং ইসলামপন্থিদের উত্থান আছে এবং তারা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়েছে। এ দেশের মাটি ও শেকড়ের সঙ্গে ইসলামপন্থিদের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু তাদের উত্থানের পর বা গণজোয়ারের পর এটাকে ধরে রাখার বা ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ব্যাপারে তারা ব্যর্থ হয়েছে।

তাই প্রথম কথা হচ্ছে যে, ইসলামপন্থিদের উত্থান আছে, জোয়ার আছে কিন্তু এটিকে সাংগঠনিকভাবে রূপ দিয়ে বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামপন্থিদের যে অবস্থান তৈরি হওয়ার কথা তা তৈরি হয়নি। এটার পেছনে অবশ্য নানাবিধ ও নানামুখী কারণ আছে। আমি মনে করি যদি আমাদের মাঝে একটি ঐক্যের মানসিকতা থাকে, অর্থাৎ বৈচিত্রের মাঝে যে ঐক্য- তা হতে পারে কর্মসূচি কেন্দ্রিক বা আদর্শিক, যেকোনো ভাবে যদি আমরা এক প্লাটফর্মে আসতে পারি এবং সবার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির একতা ও একমনা থাকত তাহলে হয়ত আমরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেই উত্থানের প্রকাশ ঘটাতে পারতাম এবং এর শক্তি প্রদর্শন করতে পারতাম।

যুগান্তর: যে সমস্যার কথা বললেন তা কি বাড়ছে নাকি কমছে? সামনে কি ইসলামপন্থিদের সম্ভাবনা না হতাশা কোনটা দেখছেন আপনি?

মুফতি ফয়জুল্লাহ: এর সম্ভাবনা সবসময় দেখা যায় না। সব সম্ভাবনা যে সর্বদা দৃশ্যমান হবে এমনটাও না। আমরা চোখ দিয়ে যা দেখি বাস্তবে তা নাও হতে পারে। আবার যা হচ্ছে তা আমরা নাও দেখতে পারি। তবে আমি মনে করি আমাদের নিজস্ব একটি বলয় আছে এবং এক্ষেত্রে যদি আমরা একতা বজায় রেখে একটি জায়গা তৈরি করতে পারি তাহলে আমাদের অবস্থা ভালো হবে এবং এর একটি সুন্দর সম্ভাবনাও আছে।

যুগান্তর: এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের আগ থেকেই বামপন্থি রাজনীতির চর্চা চলে আসছে এবং তাদেরও বিভিন্ন সংগঠন ও কার্যক্রম চলমান আছে। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম চলে। তবে আমরা দেখছি যে তাদেরও সে অর্থে উত্থান হয়নি।  আপনি একজন মাঠে ময়দানের রাজনীতিবিদ হিসেবে বামপন্থীদের বিষয়ে সামগ্রিকভাবে কি বলবেন?

মুফতি ফয়জুল্লাহ: প্রথমত আমি বামপন্থিদের নিয়ে কোনো মন্তব্য আসলে করতে চাই না। এটি হচ্ছে সেই নীতি বা আদর্শ যাকে আমরা বলি বস্তাপচা জিনিস। এ জন্য এখন দেখা যায় যে আমাদের রাস্তার আশেপাশে কাল মার্কস বা মাও সেতুংয়ের বইগুলো ওজন হিসেবে বিক্রি করা হয়। এদেশে বামপন্থার উত্থান হওয়ার অবস্থা কখনোই ছিল না, আজকের দিনেও নেই এবং ভবিষ্যতেও এদের অবস্থা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকবে। এদের বিরুদ্ধে মন্তব্য করার কি আছে! আমাদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে যে মানুষ আছে তাদের পুরো বাংলাদেশ খুঁজলেও এত মানুষ পাওয়া যাবে না।

তবে হ্যাঁ, তাদের একটি সাহিত্য সংস্কৃতিতে জায়গা আছে তো সে জায়গাগুলেই তাদের জন্য বেটার। তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করবে, ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান তারা স্পষ্ট করবে এজন্য তাদের জায়গাগুলোতে তারা থাকুক। কিন্তু আমি মনে করিনা বাংলাদেশের মত জায়গার তাদের উত্থান হওয়ার কোনো সুযোগ আছে।

যুগান্তর: ইসলামী ঐক্যজোট বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় দল যারা আগেও বিভিন্ন চমক দেখিয়েছেল।  তো ইসলামী ঐক্যজোট আগামী নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে?

মুফতি ফয়জুল্লাহ: ইসলামী ঐক্যজোট নামটিই হচ্ছে নিবন্ধিত ইসলামিক দল। আমরা আগামী নির্বাচন নিয়ে এখনো সাংগঠনিক অবস্থা তৈরি করছি এবং সংগঠনকে মজবুত ও শক্তিশালী  করার জন্য দেশব্যাপী কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং সারাদেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম শেষে আমাদের কাউন্সিল করার নৈতিক একটি সিদ্ধান্ত আছে। তো এর পরে আগামী জুন-জুলাইয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা করব। এখন আমরা মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি আগামী নির্বাচন উপলক্ষ্যে।

যুগান্তর: এক্ষেত্রে কি আপনারা বড় দুই দলের জোটের সঙ্গে যাবেন নাকি নিজেদের মধ্যে আলাদা কোনো জোট করার চিন্তাভাবনা আছে?

মুফতি ফয়জুল্লাহ: যাদের বড় দল বলা হচ্ছে প্রথমত আমরা তাদের বড় দল মানি কিনা তা একটি বিষয়। তাছাড়া দুটির মধ্যে কোনো একটি জোটে যাওয়ার কোনোরকম চিন্তাভাবনা আমাদের নেই। তাদের কারও সঙ্গেই জোটে যাওয়ার চিন্তাভাবনা নেই। আমরা ইসলামপন্থিদের মধ্যে একটি সমঝোতা ও সমন্বয় যদি গড়ে তুলতে পারি তাহলে আমরা মনে করি যে এ দেশের মুসলিম এবং ইসলামপন্থীদের কল্যাণে মানুষের সমৃদ্ধির জন্যে ও মদিনা সনদের রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাবার জন্য ভালো হবে।

যুগান্তর: ২০১৬ সালে যখন আপনারা বিএনপি থেকে বের হয়েছিলেন তখন বলেছিলেন যে আপনারা ইসলামপন্থিদের নিয়ে একটি জোট করবেন। এরপর আর কোনো সম্ভাবনা দেখা যায়নি এ ব্যাপারে। এবার এমন কোনো পরিকল্পনা আছে?

মুফতি ফয়জুল্লাহ: সব চিন্তাভাবনা বা সব স্বপ্ন সবসময় বাস্তবায়ন হয় না। আমাদের পরিকল্পনা ছিল যে আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা বা বলয় তৈরি করা। ইসলামপন্থিদের শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া। তাদের দেশের মধ্যে এমন একটি পরিসরে নিয়ে যাওয়া যে ইসলামপন্থিদের ছাড়া যেন কেউ ক্ষমতায় যেতেও না পারে  আবার ক্ষমতায় থাকতেও না পারে। এমন পজিশন যদি আমরা তৈরি করতে পারতাম অর্থাৎ তারা কারও মুখাপেক্ষী হবে না বরং সব দল তাদের মুখাপেক্ষী হবে। এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার একটি চিন্তাভাবনা ছিল আমাদের এবং সেভাবে আমরা কাজ করেছি। তবে মাঝখানে স্বাভাবিক অবস্থা থাকেনি এবং রাজনীতিতে স্বাভাবিক অবস্থা থাকেওনা। এর মাঝে আমাদের যতদুর অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল ততদুর অগ্রসর হতে পারেনি। কিন্তু ভবিষ্যতে আমরা এই কর্মপরিকল্পনা নিয়েই অগ্রসর হব।

যুগান্তর: হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে যদি কারও নাম নেওয়া হয় আপনি তাদের একজন। কিন্তু বর্তমান হেফাজতের সঙ্গে আপনি নেই, বিষয়টিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মুফতি ফয়জুল্লাহ: শাইখুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী (রহ.) প্রতিষ্ঠিত যে হেফাজত সেই হেফাজতের সঙ্গে বর্তমানে যে হেফাজত রয়েছে তার কোনো সম্পর্ক নেই। অতএব আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। এখন যে হেফাজত চলছে বা প্রচলিত আছে এটা কার হেফাজত? এটি তো শাইখুল ইসলামের (রহ.) হেফাজতে ইসলাম না।

যুগান্তর: আপনারা কি তাহলে হেফাজতে ইসলামকে পুনরুদ্ধার করবেন না?

মুফতি ফয়জুল্লাহ: আমরা সময় আসলেই সব বলব এবং সময়ই কথা বলবে। সময়ই আমাদের বলবে যে কী করতে হবে। তখন আমরা করণীয় নির্ধারণ করে সারাদেশের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম এবং হেফাজতের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও আল্লামা আহমদ শফীর যেসব প্রতিনিধি হেফাজতের সূচনালগ্ন থেকে ছিলেন তাদের নিয়ে চিন্তাভাবনা আমরা পরবর্তীতে ঠিক করব।

যুগান্তর: ইসলামী ঐক্যজোটেরও শুরু থেকে আপনি আছেন। সেই কর্মী থেকেই। তো আজকে ২০ বছর পরে ইসলামী ঐক্যজোটকে আপনি কোন অবস্থানে দেখছেন?

মুফতি ফয়জুল্লাহ: আমাদের সুনির্দিষ্ট যে পরিকল্পনা আছে তা সবসময় বাস্তবায়িত হয় না। আমি ২০ বছরের চিন্তা করি না বরং আমি দেখি যে পাঁচ বছর পরেই যেন আমরা একটি মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হতে পারি- এ চিন্তাটাই আমরা সবসময় করি। সেদিক দিয়ে যেভাবে ইনশাআল্লাহ উত্থান হচ্ছে এবং সারা দেশের নেতাকর্মীরা যেভাবে উজ্জীবিত হয়ে আবার মাঠে ময়দানে কাজ করছেন, আমি মনে করি ইনশাআল্লাহ ইসলামী ঐক্যজোট আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে।

যুগান্তর: কওমি মাদ্রাসায় সাম্প্রতিক আমরা বিভিন্ন অস্থিরতা দেখেছি। কওমি মাদ্রাসাগুলোর সামগ্রিক পরিস্থিতি কী?

মুফতি ফয়জুল্লাহ: কওমি মাদ্রাসা মূলত শান্তিপ্রিয় মানুষ গড়ার কেন্দ্র। আলোকিত মানুষ কওমি মাদ্রাসায় তৈরি করে। কিন্তু মসজিদের মধ্যে যেমন চোর মাঝেমধ্যে ঢুকে যায় তেমনিভাবে কওমি মাদ্রাসার মধ্যেও বিভিন্নপন্থি বা বিভিন্ন লেবাসধারী কিছু মানুষ ঢুকে গেছে। আসলে তারাই মূলত বিভিন্ন ধরনের ফেতনা তৈরি করছে। এসব ফেতনা সম্পর্কে আমি মনে করি এখন কওমি মাদ্রাসার ৯৫ বা ৯৮ ভাগ ছাত্র উস্তাদ সচেতন রয়েছেন। তাই কোনো ফেতনা কওমি মাদ্রাসাকে ধ্বংস করতে পারবে না এবং ভিন্নপথেও নিয়ে যেতে পারবে না।

যুগান্তর: অনেকেই বলে বা আপনাদের লোকজনই বলেন যে, আপনারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য রাখেন। এ বিষয়ে কী বলবেন? এ সমালোচনার জবাব কিভাবে দেবেন?

মুফতি ফয়জুল্লাহ: আমি সমালোচকদের অভিনন্দন জানাই এবং সমালোচনাকে গ্রহণ করি। আমি মনে করি ইসলামী ঐক্যজোট নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে কাজ করছে। আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি বা অমুক-তমুকের সঙ্গে কোনো সখ্য আমাদের নেই। হ্যাঁ, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যে একটা ওঠাবসা বা কথাবার্তা থাকে সে ধরনের যোগাযোগ থাকতে পারে কিন্তু কোনো দলের হয়ে ইসলামী ঐক্যজোট কাজ করে না এবং কোনো দলের জোটের মধ্যে ২০১৬ সালের পর থেকে নেই। সামনেও থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

অনুলিখন করেছেন- কাজী আব্দুল্লাহ

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।