মারাত্মক ক্ষতিকর সম্মুখিন উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি: মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততায় উৎপাদন হ্রাস: সমৃদ্ধির স্বপ্ন হতে চলেছে বিপন্ন

আবু সাইদ বিশ্বাস, ক্রাইমবাতা রির্পোট, সাতক্ষীরাঃ অব্যাহতভাবে কৃষি জমি হ্রাসে খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। উপকূলীয় অঞ্চলে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততায় ভূমির উর্বরতা ব্যাপক ভাবে হ্রাস পেয়েছে। নিবিড় চাষাবাদের ফলে মৃত্তিকা কার্বন হ্রাস পাচ্ছে। জৈব পদার্থের ‘টপ সয়েল’ চলে যাচ্ছে ইটভাটার চিতানলে। দরিদ্র কৃষককে দুটো কাঁচা পয়সার প্রলোভন দেখিয়ে ইটভাটার মালিক বস্ত্রহরণ করে গিলে খাচ্ছে ফসলি জমি। ইটভাটার দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে পুষ্টিসমৃদ্ধ উর্বর টপ সয়েল। বিশ্বব্যাংকের ‘রিভার স্যালাইনিটি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাভিডেন্স ফ্রম কোস্টাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের ১৯ জেলার ১৪৮টি থানার মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততায় আক্রান্তহবে ১০টি নদীর পানি। এর মধ্যে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জ উপজেলার নদীগুলো উল্লেখযোগ্য। এসব এলাকায় এখনই ১০ পিপিটি মাত্রার লবণাক্ততা বিরাজ করছে। যা ২০৫০ সালের মধ্যে স্থানভেদে ১৫-২৫ মাত্রায় উন্নীত হতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে ফসলি জমি প্রায় ৭ দশমিক ২৯ মিলিয়ন হেক্টর। পৃথিবীর মোট ভূখন্ডের প্রায় ১০ শতাংশ জায়গায় ফসল আবাদ হলেও বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ৬০ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার দক্ষতা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। আবাদি জমি কমে যাচ্ছে অব্যাহতভাবে। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ধোয়া তুলে, সমৃদ্ধ আগামীর কথা বলে তিন ফসলি কৃষিজমি চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছে শিল্পপতির উদরে। ক্রমবর্ধমান বঙ্গসন্তানের অন্ন জোগাতে মাটি যেন আজ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। নিখুঁত ও দক্ষ নীতি-কৌশল নিয়ে না এগোলে চরম সংকটে পড়তে পারে মৃত্তিকাকেন্দ্রিক বাংলার কৃষি অর্থনীতি, জীবন ও জীবিকায়ন।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, উন্নয়নের মহরতে মানুষ যখন লাগামহীন জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার আর বন উজাড় শুরু করল, তখন পরিবেশবাদী, গবেষকেরা সতর্ক করেছিলেন এর পরিণাম নিয়ে। আজ বায়ুন্ডল আর সইতে পারছে না কার্বনের বোঝা। বায়ুমন্ডলে কার্বনের মাত্রা যখন সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া শুরু করল, তখন শুরু হলো প্রলয়। আজ ভোগবাদী পৃথিবীর ঘুম হারাম হয়ে গেছে। বাঁচার আকুতি করছে তারা। ফলে ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু তহবিল নিয়ে শুরু হয়েছে নানা কর্মযজ্ঞ। ভোগবাদী বিশ্বের নিরবচ্ছিন্ন সমৃদ্ধির স্বপ্ন আজ বিপন্ন হতে চলেছে।
এদিকে “মাটি: খাদ্যের সূচনা যেখানে” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২২ উপলক্ষে সাতক্ষীরায় বর্ণাঢ্য র‌্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার (৫ ডিসেম্বর) সকাল ১০টায় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট আঞ্চলিক কার্যালয় সাতক্ষীরা’র আয়োজনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামার বাড়ি সাতক্ষীরা’র উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. জামাল উদ্দিন’র সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কাজী আরিফুর রহমান। প্রধান অতিথির বক্তব্য তিনি বলেন, অপ্রয়োজনীয় সার কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কারণ অপ্রয়োজনীয় সার কীটনাশক ব্যবহারে দিন দিন মাটি তার উর্বরা শক্তি হারাচ্ছে। সেকারণে ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট আঞ্চলিক কার্যালয় সাতক্ষীরা’র উপরিচালক অলি আহমেদ ফকির, সাতক্ষীরা হটিক্যালচার সেন্টারের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. আমজাদ হোসেন, বিনা উপকেন্দ্র সাতক্ষীরা’র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বাবুল আক্তার, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ খালিদ সাইফুল্লাহ প্রমুখ। সমগ্র অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট সাতক্ষীরা আঞ্চলিক কার্যালয়ের উদ্বর্তন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শামসুন নাহার রতœা। ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভার ৬৮ তম অধিবেশনে অনুমোদিত সংকল্পের মাধ্যমে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালিত হয়। প্রতি বছর এই দিবসটি পালনের একটি বিশেষ থিম থাকে। এবছরের থিম মাটি- যেখানে খাদ্য শুরু হয়।
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি অফিসার এস এম এনামুল ইসলাম ‘মে ২০২১’ থেকে ‘মে ২০২২’ পর্যন্তসময়কালের চিত্র তুলে ধরে বলেন, শ্যামনগর উপকূলীয় এলাকায় লবণের মাত্রা ৩ থেকে ৪ ডিএস/মিটার। যতদিন যাচ্ছে, লবণের মাত্রা আরও বাড়ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের পানির উচ্চতা বাড়ার ফলে লবণের মাত্রা ১৮ ডিএস/মিটার পর্যন্তবেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। যা মারাত্মক ক্ষতিকর। শুধু কৃষি-প্রাণবৈচিত্র্য নয়, লবণাক্ততায় ক্ষতি হয় মৎস্যচাষিদেরও।
ভুক্তভোগীরা বলছে, ক্লাইমেটের বারোটা বাজিয়ে এখন ‘ক্লাইমেট জাস্টিস’ নিয়ে এখন সরব হয়েছে বিশ্বসভ্যতা। কার্বনের ঝাঁকিতে গ্লোবাল সিস্টেম এখন এলোমেলো, হার্ডওয়্যার-সফটওয়্যার ছিন্ন–বিচ্ছিন্ন। দিবস পালনের দায়সারা আনুষ্ঠানিকতা আর কেতাবি অঙ্গীকার থেকে বেরিয়ে সরকার, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, সুশীল সমাজ, মিডিয়া কর্মী, ব্যবসায়ী, কৃষক, ছাত্র-ছাত্রী—সবাইকে কার্যকর অবদান রাখতে হবে ‘সয়েল কনজারভেশন ব্রিগেডে’। মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার প্রধান কারিগর কৃষকের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, তাঁদের মর্যাদার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। শক্ত আইন প্রণয়ন ও তার কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে অমূল্য মৃত্তিকা সম্পদ রক্ষায়।

 

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।