বাউল শিল্পীর মেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট

সাতক্ষীরা কলারোয়া উপজেলার কেরেলকাতা ইউনিয়নের নিজ বাড়িতে পরিবারের সাথে ডান থেকে বাউল শিল্পী বাবা মোতাহার মন্ডল,  ৪০তম বিসিএস এডমিন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত মেধাবী ছাত্রী আসমা আক্তার মিতা, ভাই ফয়সাল হোসেন রিকো ও মা ঝর্ণা খাতুন। ছবি: আজকের পত্রিকা বাবা ফকির সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক বাউল গানের শিল্পী হওয়ায় সাংসারিক জীবন থেকে অনেকটা আলাদা পরিবেশে বসবাস করতেন। বিচ্ছিন্ন এ পরিবারে ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। নিয়মিত অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার সঙ্গে লড়াই চালালেও ঝরে পড়েননি মেধাবী শিক্ষার্থী আসমা আক্তার মিতা ৷ অভাবের মাঝেও খেয়ে না খেয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেই আসমা আক্তার মিতা ৪০ তম বিসিএস ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন।

পরিবারে দৈন্যদশায় ছোট থেকেই মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম দেখেছেন মিতা। থাকতেন দিনমজুর নানা–নানির খুপরি ঘরে। তাদের অনুপ্রেরণায় লেখা পড়া চালিয়ে যান মিতাসহ তার বড় বোন ও মেজো ভাই।

মিতা যে বিদ্যাপীঠ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেছেন সেই কাজীরহাট ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ এসএম শহিদুল ইসলাম।

তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, সাতক্ষীরা কলারোয়া উপজেলার ৮ নম্বর কেরেলকাতা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম কিসমত ইলিশপুরের দক্ষিণ পাড়ার ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আসমা আক্তার মিতা। তাঁর বাবা মোতাহার হোসেন মণ্ডল একজন আধ্যাত্মিক সাধক মারফতি ফকির সম্প্রদায়ের বাউল শিল্পী। তিনি শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত ফকির মেলায় গান করে থাকেন। তার মা ঝর্ণা খাতুন পেশায় গৃহিণী। এইচএসসি পরীক্ষায় কাজীরহাট ডিগ্রি কলেজের ১২ জন এ প্লাস প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিতা গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে সরকারি উপবৃত্তিসহ স্কলারশিপ পেয়েছেন যা তার লেখাপড়ার খরচ বহনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

গত ৩০ মার্চ দুপুরে ৪০ তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। পিএসসির চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন। এতে প্রশাসন ক্যাডারে ২৪৫, পুলিশে ৭২, পররাষ্ট্রে ২৫, কৃষিতে ২৫০, শুল্ক ও আবগারিতে ৭২, সহকারী সার্জন ১১২ ও পশুসম্পদে ১২৭ জনসহ মোট ১ হাজার ৯৬৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশ করা হয়েছে। মিতা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৬০ নম্বর সিরিয়াল অর্জন করে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।

 

আসমা আক্তার মিতা আজকের পত্রিকার একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে এই সফলতা অর্জন করেছেন। যে নানা নানির কঠোর পরিশ্রম ও অনুপ্রেরণায় আজ ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে সেই মানুষ গুলো বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে তাদের মতো খুশি আর কেউ হতো না ৷’

তিনি জানান, তিন ভাই-বোনের মধ্যে আসমা খাতুন ছোট। একমাত্র ভাই ফয়সাল হোসেন রিকো দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও এসএসসি পরীক্ষা দেননি। বর্তমানে সামান্য বেতনে বাস মালিক সমিতিতে কাজ করে। সে সবার বড়। বড় বোন রেশমা আক্তার লতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ২০১৫ সালে মাস্টার্স শেষ করেন। বর্তমানে সে চাকরি খুঁজছে।

বড় বোন রেশমা আক্তার লতা বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার কাছে বর্ণমালার হাতেখড়ি হয়েছে মিতার। সে কে কে ইপি সম্মিলিত মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় এ প্লাস প্রাপ্ত হন। এবং কাজিরহাট ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১২ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস  করে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে। জীবন এখানে এসে ডানা মেলে ধরতে শুরু করে তা&র। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সাতক্ষীরার অজপাড়াগাঁয়ের সেই মেয়টি এখন প্রশাসনে বিসিএস ক্যাডার।’

আসমার বাবা সুফিবাদ তরিকার সাধক বাউল শিল্পী মোতাহার হোসেন বলেন, ‘অভাবের সংসারে কষ্ট করে হলেও মেয়েকে লেখাপড়া করিয়ে আজ আল্লাহর রহমত ও সবার দোয়ায় এই সফলতা। আমার মেয়ে যেন আরও বড় হয়ে এলাকায় মুখ উজ্জ্বল করতে পারে দেশ ও জনগণের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তার জন্য সবার কাছে দোয়া চাই। ’

স্থানীয় কিসমত ইলিশপুর ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মুজিবুর রহমান মজি বলেন, ‘মিতা ছোট থেকে সৎ অত্যন্ত কোমল স্বভাবের ও পরিশ্রমী মেধাবী শিক্ষার্থী। তাঁর এই কৃতিত্বে গ্রামের প্রতিটি মানুষ আজ খুশি।’

মজি বলেন, ‘মিতা ছোট থেকে সৎ অত্যন্ত কোমল স্বভাবের ও পরিশ্রমী মেধাবী শিক্ষার্থী। তাঁর এই কৃতিত্বে গ্রামের প্রতিটি মানুষ আজ খুশি।’

কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস বলেন, ‘উপজেলার ৮ নম্বর কেরেলকাতা ইউনিয়নের ইলিশপুর দক্ষিণ পাড়া গ্রামের মেধাবী ছাত্রী আসমা আক্তার ৪০ তম বিসিএস অ্যাডমিন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তা&র প্রতি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রইল শুভ কামনা।’

Check Also

সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।