ঘটনাটি নজিরবিহীন, অস্বাভাবিকও বটে। একজন রাষ্ট্রদূতকে গ্রহণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন সাফাই চিঠি লিখেছিলেন, কিন্তু তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। বিফলে গেছে ৬ মাসের চেষ্টা, তদবির। ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়ায় পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছিল পেশাদার কূটনীতিক মো. তৌহিদুল ইসলামকে। কিন্তু তাকে গ্রহণ করেনি ভিয়েনা। জানা গেছে, বহু বছর আগে ইতালির মিলানে কনসাল জেনারেল থাকা অবস্থায় তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অধস্তন এক নারী সহকর্মীর সঙ্গে অসদাচরণের গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল। সেই অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসা ছিল অস্ট্রিয়া সরকারের। ওয়াকিবহাল সূত্রের ধারণা, প্রত্যাখ্যানের পেছনে সেই অভিযোগ অন্যতম কারণ হতে পারে। মিস্টার ইসলামের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিস্তৃত তদন্ত করে যে তাকে প্রমোশন এবং পোস্টিং দেয়া হয়েছে তার দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে অস্ট্রিয়ার ইউরোপিয়ান এবং আন্তর্জাতিক অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক ফেডারেল মন্ত্রীর কাছে পাঠানো পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের চিঠিতে। দূতকে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে গুরুত্বপূর্ণ ওই মিশনে নতুন রাষ্ট্রদূত না পাঠনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেগুনবাগিচা।
গত ১৯শে সেপ্টেম্বর অস্ট্রিয়া সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর পাঠানো চিঠির একটি কপি পেয়েছে মানবজমিন। যেখানে দেখা গেছে অস্ট্রিয়ার ফেডারেল মিনিস্টার ফর ইউরোপিয়ান অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স আলেকজাণ্ডার সলেনবার্গকে লেখা চিঠিতে প্রস্তাবিত দূতের বিরুদ্ধে অভিযোগ খণ্ডন তথা তাকে ‘জায়েজে’ বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন।
তার ওই চিঠির সত্ত্বেও রাষ্ট্রদূতকে গ্রহণ না করায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ার কথা স্বীকার করেছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত হয়েছে, তাতে তার অপরাধ প্রমাণিত হয়নি। বিষয়টি অস্ট্রিয়া সরকারকে জানানো হয়েছে। কিন্তু তারপরও তারা তাকে গ্রহণ করেনি। অস্ট্রিয়া সরকার কি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চিঠির জবাব দিয়েছে? জানতে চাইলে সচিব বলেন, বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে হয়তো তারা চিঠির জবাব দিবে না। আমরাও নতুন নাম পাঠিয়ে এখনই তাদের বিরক্ত করবো না । চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স দিয়ে মিশন চালাতে অসুবিধা হচ্ছে না বলেও দাবি করেন তিনি। এদিকে দূত নিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাফাই চিঠি লেখার ঘটনা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন একাধিক সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। সদ্য সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক চিঠির বিস্তারিত শোনার পর এ নিয়ে কোনো মন্তব্য নেই বলে জানান। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, আমার ৩২ বছরের সার্ভিস জীবনে এমন চিঠি দেখিনি। এটা নজিরবিহীন ঘটনা।
ভিয়েনা কনভেনশন মতে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাখানের কারণ জানাতে বাধ্য নয় রিসিভিং কান্ট্রি
পেশাদার কূটনীতিকরা বলছেন, প্রস্তাবিত রাষ্ট্রদূতকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান- একান্তই রিসিভিং কান্ট্রির এখতিয়ার। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব (এগ্রিমো) প্রেরণ এবং প্রতি উত্তর পাওয়ার প্রচলিত প্রক্রিয়া রয়েছে। যা ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী নির্ধারিত। গ্লোবালি এটাই প্র্যাকটিস। এগ্রিমো পাঠানো এবং প্রতি-উত্তরের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ গোপনীয়তার সঙ্গে করা হয়ে থাকে, কারণ এতে সেন্ডিং এবং রিসিভিং কান্ট্রির ভাবমূর্তির প্রশ্ন জড়িত। ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশন্স-১৯৬১ এর ধারা ৪(২)-এ বলা রয়েছে- কোনো রাষ্ট্রদূতকে গ্রহণে অস্বীকৃতির (এগ্রিমো প্রত্যাখ্যান) কারণ জানাতে রিসিভিং কান্ট্রি বাধ্য নয়। সূত্র বলছে, গত জুলাই মাস থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভিয়েনা মিশনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের পদটি শূন্য। সেখানে পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে ক্যারিয়ার ডিপ্লোমেট মো. তৌহিদুল ইসলামকে নিয়োগের প্রস্তাব (এগ্রিমো) করে বাংলাদেশ সরকার। জুলাই মাসের শেষে অথবা আগস্টের শুরুতে ওই প্রস্তাব যায়। এটি গ্রহণে যাতে অস্ট্রিয়া সরকার রাজি হয় সেজন্য যথোপযুক্ত কূটনৈতিক চ্যানেলে দফায় দফায় যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু একটা পর্যায়ে মনে হয় ভিয়েনা প্রস্তাবিত বাংলাদেশ দূতকে গ্রহণে রাজি নয়। এ অবস্থায় নতুন নাম পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু না, বিষয়টিতে নজিরবিহীনভাবে যুক্ত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি দেশটির সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের তাগিদ দেয়া ছাড়াও একটি সাফাই চিঠি লিখে বসেন। যাতে উভয় পক্ষই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে।
মন্ত্রীর চিঠিতে যা বলা হয়েছে-
চিঠিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন অস্ট্রিয়ার ফেডারেল মিনিস্টারকে লিখেন- মহোদয়, আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, অস্ট্রিয়াতে পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে মো. তৌহিদুল ইসলামকে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। বিষয়টি আপনার বিবেচনায় রয়েছে। তার নিয়োগ প্রস্তাব (এগ্রিমো) দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সম্মানের সঙ্গে নিম্নোক্ত পয়েন্টগুলো তুলে ধরছি- মন্ত্রী লিখেন- বহুপক্ষীয় এবং দ্বিপক্ষীয় কূটনীতিতে অভিজ্ঞ তৌহিদুল ইসলাম বাংলাদেশের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কূটনীতিকদের অন্যতম। এ জন্য অস্ট্রিয়ার জন্য তাকে বাছাই করা হয়েছে। নিউ ইয়র্কে তিনি আমাদের জাতিসংঘ মিশনে দীর্ঘ চার বছর আমার সঙ্গে (মন্ত্রী মোমেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি থাকাকালে) কাজ করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তাকে দক্ষ এং সফল কূটনীতিক হিসেবে আমি নিজে তত্ত্বাবধান করেছি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে কূটনীতিতে পোস্টগ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করা তৌহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন পরীক্ষায় তার ব্যাচে প্রথম। মিশন প্রধান হিসেবে একজন কর্মকর্তাকে মনোনয়ন দেয়া বাংলাদেশে একটি বিশাল কাজ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নৈতিকতা, বুদ্ধিবৃত্তিক, ব্যক্তিগত আচরণ এবং সার্ভিস রেকর্ডে বড় রকম পরীক্ষায় পাস করতে হয়। তা তত্ত্বাবধান করে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বডি এবং সরকারের এজেন্সিগুলো। এর সব বাধা পাস করার পর রাষ্ট্রদূত তৌহিদ ইতালি এবং চীনে মিশন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গত দুই বছর ধরে তিনি সিঙ্গাপুরে হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সামাজিক ও মূলধারার মিডিয়াকে পুঁজি করে বাংলাদেশে যে কেউ যে কারও বিরুদ্ধে বেপরোয়াভাবে অভিযোগ উত্থাপন করতে পারেন। অতীতে এসব মিডিয়া প্রপাগাণ্ডার শিকার হয়েছেন আমাদের অনেক কর্মকর্তা। যাই হোক, এসব অভিযোগের প্রতিটিই মন্ত্রণালয়ের বিভাগীয় প্রক্রিয়ায় পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা হয়েছে। তাতে যদি দেখা যায় ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অসত্য এবং ভিত্তিহীন, তাহলেই তাকে পুনর্বাসন করা হয়। পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে জনাব তৌহিদও একই রকম জোরালো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, তার বর্ণিল ক্যারিয়ারে সব বাধা অতিক্রম করেছেন। তাকে ডিরেক্টর (জাতিসংঘের ডি-১ র্যাংকের সমতুল্য) পদ থেকে ডিরেক্টর জেনারেল (ডি-২) হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে তাকে চীন ও সিঙ্গাপুরে মিশন প্রধান করা হয়। তাই আমি তার উচ্চ নৈতিকতা ও আচরণের বিষয়ে নিশ্চিত। বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ ও অস্ট্রিয়া উভয়ের মঙ্গলের জন্য তিনি ভিয়েনাতে উত্তম একজন রাষ্ট্রদূত হবেন। অস্ট্রিয়াতে রাষ্ট্রদূত তৌহিদ সম্পর্কে আর কোনো তথ্য প্রয়োজন হলে আমি যেকোনো সময় আনন্দের সঙ্গে তা সরবরাহ করবো। এমন একজন প্রতিশ্রুতিশীল রাষ্ট্রদূতকে সুযোগ দেয়ার জন্য আপনার সদয় নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে আছি, যাতে তিনি প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন এবং অস্ট্রিয়াতে স্বাধীনতা, মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে পারেন।