মুজাহিদুল ইসলাম,সাতক্ষীর: পৃষ্টপোষকতা পেলে বহুমুখী ব্যবহারে সম্ভাবনাময় ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ গোলপাতা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সুন্দরবন উপকূলের বিকল্প কর্মসংস্থান হতে পাওে গোলপাতা। গোলপাতার গোল গুড় সুখ্যাতি রয়েছে সারা দেশে। বহুমুখী ব্যবহার ও সহজলভ্যতার কারণে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ এর সঙ্গে ব্যাপকভাবে পরিচিত। প্রাচীণ কাল থেকে ‘গোলগাছ যেমন মানুষের ঘরনির্মাণসহ প্রকৃতি রক্ষায় একটি বড় ভূমিকা রেখে চলেছে। এ ছাড়া গুড় থেকে বিশাল একটা অর্থ আয়ের পাশাপাশি হাজারো মানুষের ওপর নিভর্রশীল হয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। এমনকি ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষ সহনশীল পরিমাণে গোলগুড় খেতে পরামর্শ দিচেছ সংশ্লিষ্টরা। অনেক পরিবারের প্রধান আয়ের উৎস হয়ে উঠছে গোলপাতা গাছ। এ উদ্ভিদ থেকে পাওয়া রসে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু গুড়। এছাড়া প্রতিবছর ২৮ জানুয়ারী থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত চলে গোল পাতা আহরণ মৌসুম। আজ রোববার থেকে সুন্দরবন থেকে গোলপাতা আহরণ মৌসুম শুরু হচ্ছে। বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে বাওয়ালিরা গোলপাতা আহরণ করতে নৌকা নিয়ে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবেন। গত ২৪ জানুয়ারি পূর্ব সুন্দরবেনর চাঁদপাই রেঞ্জ অফিসে বাওয়ালিদের নিয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। গোলপাতা আহরণ মৌসুম নির্বিঘেœ সম্পন্ন করতে বাওয়ালিদের বন বিভাগের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
সুন্দরবনের চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান জানান, শেলা নদী ২ নং কম্পার্টমেন্ট থেকে ৪হাজার কুইন্টাল ও চাঁদপাই ৩নং কম্পার্টমেন্ট থেকে ৩হাজার কুইন্টাল গোলপাতা সংগ্রহ করবে বাওয়ালিরা। গোলপাতা ছাড়া কোনো কাঠ সংগ্রহ করতে পারবেন না। প্রতি কুইন্টালের জন্য রাজস্ব ধরা হয়েছে ৬০ টাকা। একটি নৌকায় সর্বোচ্চ ২০০ কুইন্টাল গোলপাতা বহন করা যাবে। অতিরিক্ত বহন করলে দ্বিগুণ টাকা জরিমানা করা হবে।
সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢেউটিনের বিকল্প হিসেবে ঘরের ছাউনিতে গোলপাতা ব্যবহার করে থাকেন। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের বসতঘর ও রান্নাঘরের চাল ছাউনির অন্যতম উপাদান গোলপাতা। গোলপাতার ঘর পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী। এ পাতা দিয়ে তৈরি ঘরে শীত মৌসুমে ঠান্ডা অনুভব হয় না। আবার গরমের সময় তেমন গরম অনুভব হয় না। গোলপাতার ঘর হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর বসবাসের সবচেয়ে উপযোগী। এ পাতার দাম টিন বা অন্য যে কোনো ধরনের ছাউনির চেয়ে অনেক কম। তাই এ অঞ্চলের মানুষের কাছে গোলপাতার বেশ সমাদর রয়েছে। প্রতি গোলপাতা আহরণ মৌসুমে এ অঞ্চলের কয়েক হাজার বাওয়ালি গোলপাতা আহরণ, পরিবহন ও বিক্রির কাজে সংশ্লিষ্ট থাকেন।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ সূত্র জানায়, এ এলাকা থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৩ হাজার ৭৯১ কুইন্টাল গোলপাতা আহরণ করা হয়। এ থেকে রাজস্ব পাওয়া যায় ১৬ লাখ ১০ হাজার ৪৮৩ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭২ হাজার ১০ কুইন্টাল আহরণে রাজস্ব আসে ১৮ লাখ ২৪৮ টাকা। এছাড়া ২০১৬-১৭ বছরে ৫০ হাজার ৯৯০ কুইন্টালে ১২ লাখ ৬৬ হাজার ৬৭৯ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৪ হাজার ৫৬ কুইন্টালে ১৮ লাখ ৬৫ হাজার ৫৬৫ টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৯৫ হাজার ৭১৬ কুইন্টাল গোলপাতা আহরণে রাজস্ব আয় হয় ২৩ লাখ ৯২ হাজার ৯০৩ টাকা। চলতি বছর গোলপাতা আরও অনেক কম আহরণ হবে বলে ধারণা করছে সংশ্লিষ্ট বন কর্তৃপক্ষ।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেন, আগে গোলপাতা দিয়ে এক ধরনের ছাতা, ঝুড়ি, মাদুর, থলে, খেলনা প্রভৃতি তৈরি করা হতো। এছাড়া ঘরের চাল ও বেড়ার কাজে ব্যবহƒত হতো। কালের বিবর্তনে আজ সেগুলো হারাতে বসেছে। ব্যবহার হ্রাস পাওয়ায় গোলপাতা আহরণও কমে গেছে। প্রাকৃতিক এ সম্পদের বিকল্প ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে পারলে অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে তারা মনে করছেন।
অভয়ারণ্যসহ বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার মণ পাতা নষ্ট হচ্ছে। বনের কয়েকটি অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, যেসব স্থানে গোলপাতার কূপ (প্রজনন ক্ষেত্র) রয়েছে সেসব স্থানে গোলগাছের পাতা মরে যাচ্ছে। এক জায়গায় অধিক গাছ হওয়ার কারণে এসব গাছের পাতার এমন অবস্থা। কোনো কোনো গাছে মাইজ পাতা (মধ্যখানের শিশু পাতা) বাদে সব পাতাই নষ্ট হয়ে গেছে। স্থানীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা ও বাওয়ালিরা বলছেন, পাতা না কাটার কারণেই নষ্ট হচ্ছে। এতে ফল প্রদানের পরিমাণও কমে যাবে গাছের।
গোলপাতা ব্যবসায়ীরা জানান, আগে গোলপাতা বহনকারী নৌকার দুই পাশে ঝুল (ভারসম্য) হিসেবে বনের বিভিন্ন ধরণের গাছ কেটে আনা হতো। কিন্তু এখন সেগুলো কাটা নিষিদ্ধ করায় দেশীয় গাছ নিয়ে ঝুল হিসেবে ব্যবহার করায় খরচও বাড়ছে ব্যবসায়ীদের। এতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে তারা। এদিকে সরকারি রাজস্বের চেয়েও বেশি টাকা দিতে হয় বনবিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের বলে অভিযোগ উঠছে। এ কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা বেশি করে গোলপাতাবোঝাই করতে বাধ্য হন। বাওয়ালি বলেন, পাস পারমিট বাদেও প্রতি স্টেশনে বখশিশ দিতে হয় বন কর্মকর্তাদের।
সুন্দরবনের চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান জানান, গোলপাতা নিয়ে ফেরার সময়ে নৌকার ঝুল হিসেবে বন থেকে কোনো গাছ কাটতে পারবে না বাওয়ালিরা। তিনি দাবি করেন, সরকারের রাজস্বের চেয়ে কয়েকগুণ টাকা আদায় করতে পারবে না কূপ অফিস। বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন।