দেশে আগ্রহ বাড়ছে মরণোত্তর দেহ ও অঙ্গদানে। পুরুষের পাশাপাশি পিছিয়ে নেই নারীরাও। ২০০৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এনাটমি বিভাগে প্রায় ২৩ জনের মরণোত্তর দেহদান করা হয়েছে। যার মধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ২১টি দেহ আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝে পেয়েছে। এ ছাড়া চলতি বছরে প্রথমবারের মতো মরণোত্তর অঙ্গদান ও প্রতিস্থাপন করা হয় হাসপাতালটিতে। বছরের শুরুর দিকে বিএসএমএমইউতে মরণোত্তর দেহদান করেছেন দেশবরেণ্য স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। গত ৪ঠা জানুয়ারি সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ মরণোত্তর দেহ গ্রহণ করেন ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) প্রফেসর ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। এ সময় মরণোত্তর দেহদানে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে মরদেহকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সবাইকে এক মিনিট করতালি দেয়ার অনুরোধ জানান প্রয়াত মোবাশে^রের একমাত্র ছেলে সাইদ হোসেন তমাল। উপস্থিত সবাই এক মিনিট করতালি দিয়ে প্রয়াত স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনকে শ্রদ্ধা জানান। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের মরদেহটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগে সংরক্ষণ, শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ ও গবেষণার কাজে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়।
দেশে প্রথম অঙ্গদাতা হিসেবে সারাহ ইসলামকে মানুষ আমৃত্যু মনে রাখবে। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রসঙ্গ উঠলেই সারাহ ইসলামের নাম মানুষের মনে পড়বে। ২০ বছর বয়সী সারাহ রোগশয্যায় থেকে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্যকে দান করার ইচ্ছা মাকে জানিয়েছিলেন। তার দুটি কিডনি ও দু’টি কর্নিয়া চার ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপন করেছেন দেশের চিকিৎসকরা। সারাহ’র দান করা দু’টি কিডনির একটি বিএসএমএমইউতে একজন কিডনি রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। অন্যটি বিএসএমএমইউ থেকে কিডনি ফাউন্ডেশনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে একজন নারীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। এ ছাড়া সারাহ’র দুটি কর্নিয়া দু’জনের চোখে লাগানো হয়। এ ঘটনার মধ্যদিয়ে ‘মৃত ঘোষিত ব্যক্তির’ অঙ্গ প্রতিস্থাপন করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিডনি ফাউন্ডেশনের চিকিৎসকরা। শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী রাজধানীর বাসাবোর বাসিন্দা সদ্য প্রয়াত নন্দিতা বড়ুয়ার মরণোত্তর দেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেন সন্তানরা।
তার চোখের কর্নিয়ায় ঝালকাঠির কাওখালী কলেজের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ও পটুয়াখালীর দলিল লেখক আব্দুল আজিজের চোখে আলো ফিরেছে। গত বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এনাটমি বিভাগের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ নন্দিতা বড়ুয়ার মরণোত্তর দেহ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন। এর আগে গত ৩০শে জানুয়ারি রাতে বিএসএমএমইউ’র আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬৯ বছর বয়সী নন্দিতা বড়ুয়া মারা যান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগে ভুগছিলেন। এ ছাড়া তিনি এসএলই ও ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি জীবদ্দশায় মরণোত্তর দেহদানের বিষয়টি সন্তানদের জানান। তার মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যদের সম্মতিতে বিএসএমএমইউ’র কর্নিয়া বিশেষজ্ঞরা নন্দিতা বড়ুয়ার কর্নিয়া সংগ্রহ করেন। নন্দিতা বড়ুয়ার মরদেহটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগে সংরক্ষণ, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার কাজে লাগবে। এ ছাড়া মরণোত্তর চক্ষুদান করেছেন রাজধানীর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জামাল উদ্দিন। তিনি ৬২ বছর বয়সে গত শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কো-অপারেটিভ সোসাইটির অরুণা পল্লীর বাসায় মারা যান। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মৃত্যুর পরপরই সন্ধানী ইন্টারন্যাশনাল আই ব্যাংক দু’টি কর্নিয়া সংগ্রহ করে। জামাল উদ্দিন ছিলেন মিরপুর-১৪তে অবস্থিত রোটারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক। তিনি এই প্রতিষ্ঠানে ১৯৮২ সালের দিকে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং গত ২০২১ সালের নভেম্বরে অবসরে যান। তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তির সহায়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সারাহ ইসলামের কর্নিয়া, নন্দিতা বড়ুয়ার কর্নিয়া এবং শিক্ষক জামাল উদ্দিনের কর্নিয়া সংগ্রহ করে সন্ধানী। বিএসএমএমইউ হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রতিটি মরণোত্তর দেহ গ্রহণের পর তাদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো হয়।
স্থপতি মোবাশ্বেরসহ প্রায় ২১ জনের মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয়টির এনাটমি বিভাগে সংরক্ষিত আছে। এসব মরদেহ নিয়ে হবে নানা ধরনের গবেষণা। এ ছাড়া আরও দুই ব্যক্তি মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করলেও পারিবারিক জটিলতায় মরদেহ দু’টি বুঝে পাননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মরণোত্তর দেহ এবং অঙ্গদানে উৎসাহিত করতে বিএসএমএমইউ সামনের দিকে আরও অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করবে। সমাজের বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে তাদের মাধ্যমে মরণোত্তর দেহ এবং অঙ্গদানে উদ্বুদ্ধ করতে পদক্ষেপ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এসব পরিবারকে পুরস্কৃত করা, সনদ প্রদানসহ নানাভাবে সম্মান প্রদর্শন করা হবে বলে জানায় বিএসএমএমইউ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভিসি প্রফেসর ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, এটা একটি সাদকায়ে জারিয়া। মরণোত্তর দেহদান প্রক্রিয়াটি আসলে জটিল কোনো বিষয় না। একজন মানুষ যদি অন্যকে সাহায্য করতে চায় সেটা হচ্ছে সাদকায়ে জারিয়া। মানুষের একটি অঙ্গ দিয়ে যদি আরেকজন মানুষকে বাঁচানো যায় এবং উপকার করা যায় সেটা সাদকায়ে জারিয়া। এগুলো গণমাধ্যমের মাধ্যমে, বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে সকলের উদ্দেশ্যে বলতে চাই। বিদেশে বিশেষ করে ইরান, সৌদি আরবে মরণোত্তর দেহদান করা হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশে কেন হবে না। সমাজের আলেম বা হুজুরদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে উৎসাহী করতে আমরা সামনের দিনগুলোতে ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করবো। প্রথমবারের মতো শিক্ষার্থী সারাহ’র অঙ্গদানের মাধ্যমে আমরা ইতিমধ্যে অনেকের সাড়া পেয়েছি। তারাও দান করতে আগ্রহী। একজন ব্যক্তির লিভার, কিডনি, কর্নিয়া, পাকস্থলি, হাড়, চামড়াসহ প্রায় ৮টি অঙ্গ অপর ৮ ব্যক্তিকে দান করতে পারেন। এ ব্যাপারে যারা এগিয়ে আসবেন তাদেরকে আমরা সংবর্ধনা দেবো। তাদেরকে অ্যাওয়ার্ডের ব্যবস্থা করবো। হাসপাতালে তাদেরকে ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা করে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হবে বলে জানান তিনি।