তুরস্ক ভূমিকম্প : ২২৭ ঘণ্টা পর ৭৪ বছর বয়স্ক নারী উদ্ধার

তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ২২৭ ঘণ্টা পর ধ্বংস্তূপের নিচ থেকে ৭৪ বছর বয়স্কা এক নারীকে উদ্ধার করা হয়েছে। ৬ ফেব্রুয়ারির প্রথম ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি কাহরামানমারাস থেকে একদল উদ্ধারকারী তাকে তুলে আনে।

তুর্কি মিডিয়া তার নাম সেমেলি কেকেক বলে জানিয়েছে। এত দীর্ঘ সময় ধ্বংসস্তূপে নিচে থাকার পরও জীবিত থাকা আশ্চর্য একটি ব্যাপার। একই নগরীতে এর মাত্র পাঁচ ঘণ্টা আগে ৪২ বছর বয়স্ক এক নারীকে উদ্ধার করা হয়।

সিরিয়া ও তুরস্কের ওই ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা প্রায় ৪২ হাজারে পৌঁছেছে।

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্প : দানের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকরা

তুরস্ক ও সিরিয়াতে হয়ে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পকে ব্যবহার করে প্রতারকরা লোকজনের দেয়া দানের অর্থ কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে বলে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন। এ ধরনের প্রতারণার ঘটনায় ভূমিকম্প থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন, যাদের কাছে বিদ্যুৎ পানি কিছুই নেই, তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহের কথা বলা হচ্ছে।

ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে সংগৃহীত অর্থ তাদের কাছে পৌঁছে না দিয়ে, পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে প্রতারকদের নিজেদের পেপ্যাল ও ক্রিপ্টোকারেন্সি অ্যাকাউন্টে।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এ ধরনের প্রতারণায় যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় তার কয়েকটি তারা চিহ্নিত করেছেন। এছাড়া কোথায় ও কাকে দান করা হচ্ছে, তা যাচাই করে দেখার কিছু প্রযুক্তি রয়েছে। দান করার আগে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে দানের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

টিকটক লাইভ প্রতারক
টিকটক লাইভে যারা কনটেন্ট তৈরি করছেন, তারা ‘ডিজিটাল গিফ্ট’ গ্রহণের মাধ্যমে অর্থ আয় করতে পারেন।

বর্তমানে টিকটক অ্যাপে ভূমিকম্পের নানা ধরনের কনটেন্ট পোস্ট করা হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে ধ্বংসযজ্ঞের ছবি, ভিডিও ফুটেজ, উদ্ধার তৎপরতার টিভি রেকর্ডিং ইত্যাদি।

এসব দেখানোর সময় দুর্গতদের জন্য অর্থ দান করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।

এগুলোর ক্যাপশনে বিভিন্ন ধরনের কথা লেখা আছে। যেমন ‘আসুন, তুরস্ককে সাহায্য করি’, ‘তুরস্কের জন্য প্রার্থনা’ এবং ’ভূমিকম্পের দুর্গতদের জন্য সাহায্য করুন’ এমন বিভিন্ন স্লোগান।

এ রকম একটি পোস্টের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ওই লাইভ হচ্ছিল, তাতে ওপর থেকে তোলা ভূমিকম্পে ধসে পড়া ভবনের ছবি দেখানো হচ্ছে, তার সাথে যোগ করা হয়েছে বিস্ফোরণের কিছু সাউন্ড ইফেক্ট। কিন্তু ক্যামেরার পেছনে একটি পুরুষ কণ্ঠকে হাসতে ও চীনা ভাষায় কথা বলতে শোনা যাচ্ছে। ওই ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা ‘আসুন, তুরস্ককে সাহায্য করি। দান করুন।’

আরেকটি ভিডিওতে একটি শিশুকে বিস্ফোরণ থেকে দৌড়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। ওই লাইভস্ট্রিমের বার্তায় বলা হচ্ছে ‘এই লক্ষ্য অর্জনে অনুগ্রহ করে সাহায্য করুন।’

দৃশ্যত এখানে ‘টিকটক গিফটের’ জন্য আবেদন করা হচ্ছে। কিন্তু শিশুটির যে ছবি দেখানো হচ্ছে, সেটি তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্পের কোনো ছবি নয়। ওই ছবিটির উৎস কোথায় তা জানতে সার্চ করে দেখা গেছে যে ওই একই ছবি ২০১৮ সালেও টুইটারে পোস্ট করা হয়েছে, যার ক্যাপশন ছিল ‘আফরিন গণহত্যা বন্ধ করুন।’

ওই ক্যাপশনে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার একটি শহরের কথা বলা হচ্ছে, যেখানে তুর্কি বাহিনী ও তার মিত্ররা মিলে ওই বছর একটি কুর্দি মিলিশিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে।

টিকটকে ‘গিফ্ট’ পাঠানোর ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। বিবিসির এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে ওই অ্যাপের মাধ্যমে যত ডিজিটাল গিফ্ট পাওয়া যায় তার ৭০ শতাংশ নিয়ে যায় টিকটক, যদিও টিকটক বলছে যে তারা এর চেয়ে কম নেয়।

টিকটকের এক মুখপাত্র বলেছেন, ‘তুরস্ক ও সিরিয়াতে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে, তাতে আমরা গভীরভাবে দুঃখিত। যে ধরনের ত্রাণ-তৎপরতা চলছে, তাতেও আমরা সাহায্য করার চেষ্টা করছি। যারা সাহায্য করতে চাইছেন, তাদেরকে প্রতারণা ও বিভ্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে আমরা সক্রিয়ভাবে কাজ করছি।’

ক্রিপ্টোকারেন্সি আপিল ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরি ছবি
টুইটারে লোকজন আবেগ-ঘন ছবি শেয়ার করছে। এর পাশাপাশি ক্রিপ্টোকারেন্সি অ্যাকাউন্টেরও লিঙ্ক শেয়ার করে এর মাধ্যমে অর্থ-সাহায্য দান করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। একটি অ্যাকাউন্ট থেকে মাত্র ১২ ঘণ্টায় একই আবেদন আটবার পোস্ট করা হয়েছে। ওই পোস্টে একটি ছবি দেয়া হয়েছে, যাতে দেখা যাচ্ছে দমকল বাহিনীর এক কর্মী ধসে পড়া কয়েকটি ভবনের সামনে ছোট্ট একটি শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন।

এটি আসল কোনো ছবি নয়। ওয়েমা নামের একটি গ্রিক সংবাদপত্র বলছে, এজিয়ান দমকল বাহিনীর মেজর জেনারেল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মিডজার্নি সফটওয়্যার ব্যবহার করে ওই ছবিটি তৈরি করেছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সাহায্যে ছবি তৈরির সময় প্রায়ই ভুল হয়ে থাকে। এক্ষেত্রেও টুইটার ব্যবহারকারীরা খুব দ্রুতই ধরে ফেলেন যে এই ছবিটি আসল নয়। তারা দমকল বাহিনীর কর্মীর ডান হাতে ছয়টি ডিজিট দেখতে পান। ওই ছবির সত্যতা যাচাই করার জন্য বিবিসির প্রযুক্তি গবেষণা বিভাগ ‘ব্লু রুম’-কে একই সফটওয়্যার ব্যবহার করে ঠিক একই ধরনের চিত্র তৈরি করতে বলা হয়।

এরপর সফটওয়্যারটিকে বলা হয় ‘দমকল বাহিনীর এক কর্মী, যার মাথায় থাকবে গ্রিক পতাকা আঁকা হেলমেট, ভূমিকম্পের পর তিনি ছোট্ট একটি শিশুকে উদ্ধার করছে‘ এমন একটি ছবি তৈরি করে দিতে।

এছাড়াও ওই ধরনের পোস্টের সাথে ক্রিপ্টোকারেন্সির যেসব ওয়ালেটের ঠিকানা দেয়া হয়েছে তার একটি ২০১৮ সালের প্রতারণামূলক টুইটেও ব্যবহার করা হয়েছিল। অন্য ঠিকানাগুলো পোস্ট করা হয়েছে রুশ সামাজিক মাধ্যমে ‘ভিকে’-তে। সেখানে পর্নোগ্রাফি কনটেন্টও পোস্ট করা হয়েছে।

অর্থ-সহায়তার আবেদন জানিয়ে যে ব্যক্তি টুইটারে এই আপিল পোস্ট করেছেন, বিবিসির পক্ষ থেকে তার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, এটি প্রতারণামূলক কোনো পোস্ট নয়। ‘গুগল ট্রান্সলেট’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তিনি টুইটারে প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।

তিনি বলছেন, ‘আমি যদি কোনো অর্থ সংগ্রহ করতে পারি, তাহলে আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভূমিকম্পে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সাহায্য করা। দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় লোকজন এখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে বসবাস করছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য কোনো খাবার নেই। আমি রসিদ দিয়ে এই প্রক্রিয়াকে প্রমাণ করতে পারবো।’

তবে তিনি এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের রসিদ পাঠাননি এবং তার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য কোনো প্রমাণও পাঠাননি।

টুইটার এবং পেপ্যাল
প্রতারণাকারীরা অর্থ তোলার জন্য টুইটারে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলে এবং তাতে পেপ্যালের লিঙ্কও পোস্ট করা হয়।

সফটওয়ার সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট ‘সোনাটাইপ’-এর সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আক্স শর্মা বলছেন, এসব অ্যাকাউন্ট থেকে সংবাদ প্রতিবেদনগুলো রিটুইট করা হয়। এছাড়াও এগুলো যাতে বেশি লোকজনের কাছে পৌঁছায় তার জন্য তারা জনপ্রিয় ব্যক্তি ও পরিচিত প্রতিষ্ঠানের টুইটেরও রিপ্লাই করে থাকে।

আক্স শর্মা বলছেন, ত্রাণ-সাহায্যের কথা বলে তারা ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করে যেগুলোকে বৈধ সংস্থা কিংবা সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মতো দেখায়। তারপর তারা সংগৃহীত অর্থ তাদের পেপ্যাল অ্যাকাউন্টে নিয়ে যায়।

এমন একটি উদাহরণ ‘টার্কিরিলিফ’। জানুয়ারি মাসে এ টুইটার অ্যাকাউন্টটি খোলা হয়েছে, যার ফলোয়ারের সংখ্যা মাত্র ৩১। এখানে পেপ্যাল অ্যাকাউন্টে অর্থ-সাহায্য দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

এই পেপ্যাল অ্যাকাউন্টে এখন পর্যন্ত দান হিসেবে ৯০০ মার্কিন ডলার জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৫০০ ডলার এসেছে এই পেজটি যিনি বানিয়েছেন তার কাছ থেকে।

আক্স শর্মা বলছেন, ‘অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে তাদের উদ্যোগটি যে খাটি তা দেখানোর জন্য তারা নিজেরাই নিজেদের অ্যাকাউন্টে অর্থ পাঠিয়েছেন।’

ভূমিকম্পের পর দুর্গত লোকজনের জন্য অর্থ-সাহায্য চেয়ে পেপ্যালে এমন শতাধিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ভুয়া অ্যাকাউন্টও রয়েছে।

আক্স শর্মা বলছেন, তুরস্কের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের জন্য যারা অর্থ দিতে চান তাদেরকে কিছু কিছু অ্যাকাউন্টের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে যেসব অ্যাকাউন্ট তুরস্কে বলে দাবি করা হচ্ছে সেগুলোর ব্যাপারে। কারণ পেপ্যাল ২০১৬ সাল থেকে তুরস্কে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, পেপ্যাল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তুরস্কের বাইরে এমন কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যেগুলো আসল। কিন্তু যখন তারা বলছেন যে তারা তুরস্কে আছেন, তখনই সাবধান হতে হবে।

অজ্ঞাত উৎস থেকে আসা দান এবং যেসব আপিলে সামান্য পরিমাণে অর্থ সংগৃহীত হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে। আক্স শর্মা বলছেন, মনে রাখতে হবে যে সত্যিকারের যেসব আপিল, সেগুলোতে ‘উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থ জমা হয়।’

পেপ্যাল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে যারা অর্থ-সংগ্রহ করছেন তাদের বেশিরভাগই এখন পর্যন্ত ১০০ পাউন্ডের বেশি তুলতে পারেনি।

পেপ্যাল প্রতারণামূলক অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দিয়েছে। পেপ্যালের এক মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, ‘প্রচুর মানুষ আছে যারা পেপ্যাল ব্যবহার করে দানের অর্থ গ্রহণ করছে, তারা ভালো কাজের উদ্দেশেই তা করছেন। তবে কিছু অ্যাকাউন্ট আছে যেগুলো ওই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পের পর অ্যাকাউন্টগুলোর ওপর নজর রাখা ও ভুয়া অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ করার জন্য পেপ্যালের টিম নিরলসভাবে কাজ করছে, যাতে দানের অর্থ দুর্গত লোকজনের কাছে পৌঁছাতে পারে।’

টুইটার ’টার্কিরিলিফ’ অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দিয়েছে, তবে তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

যেভাবে প্রতারণা ঠেকানো যায়
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আপনার দেশে পরিচালিত দাতব্য উদ্যোগের খোঁজ নিন। কোনো উদ্যোগকে যদি আপনার প্রতারণামূলক বলে সন্দেহ হয়, তার ব্যাপারে আপনার দেশের অথবা সংশ্লিষ্ট সামাজিক মাধ্যম কর্তৃপক্ষের কাছে জানান যে আপনি যাতে দান করেন তার জন্য আবেগ-ঘন ভাষা, ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো প্রতারক চক্র দাবি করে যে তারা কোনো দাতব্য সংস্থা বা সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট। আপনি যদি ওই দাতব্য কিংবা সরকারি সংস্থায় দান করতে চান, তাদের ওয়েসবাইটে এ সংক্রান্ত তথ্য খুঁজে দেখুন এবং সরাসরি দান করুন।

সূত্র : বিবিসি

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।