ইউক্রেনে শান্তির জন্য গৃহীত জাতিসংঘ রেজুলেশনের পক্ষে ভোটদানে ইচ্ছাকৃত বিরত থাকার ব্যাখ্যা দিয়েছে বাংলাদেশ। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মূখপাত্র সেহেলী সাবরীন রোববার সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রদত্ত বিবৃতিতে গৃহীত রেজুলেশনে যুদ্ধবন্ধে কার্যকর সুপারিশের ঘাটতি বা ত্রুটি থাকার দাবি করেছেন। সরকারি ভাষ্যটি ছিল এমন- যদিও রেজুলেশনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনে একটি ব্যাপক, ন্যায্য এবং স্থায়ী শান্তির সন্ধান করা। বাংলাদেশ বিশ্বাস করে বিদ্যমান সংঘাতের যেকোনো অর্থবহ এবং টেকসই সমাধানের জন্য অবশ্যই সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর মধ্যে নিবিড় কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা এবং কার্যকর সংলাপ প্রয়োজন।
বাংলাদেশ মনে করে, এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক পয়েন্ট বা ‘বাস্তবসম্মত পয়েন্ট’ গৃহীত রেজুলেশনে দারুণভাবে অনুপস্থিত ছিল। এ জন্য ওই রেজুলেশনের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট না দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ভোটদানে বিরত থাকতে (অ্যাবস্টেইন) অনেকটা বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশ। রেজুলেশনের পক্ষে ভোট না দেয়ায় পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসনকেই সমর্থন দিচ্ছে সমালোচকদের এমন বক্তব্যকে যুক্তি দিয়ে খণ্ডনের চেষ্টা করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা ও সংলাপের ‘বাস্তবসম্মত পয়েন্ট’ বাদ পড়ার কারণে রাশিয়ার যুদ্ধ বন্ধের জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাবে বাংলাদেশ ভোট দেয়নি বলে দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেন মন্ত্রণালয়ের মূখপাত্র।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের নিন্দা, যুদ্ধ বন্ধ ও অবিলম্বে সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান সম্বলিত বৃহস্পতিবারের প্রস্তাবটি ১৪১-৭ ভোটে পাস করেছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। প্রস্তাবে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান শ্রীলঙ্কাসহ ৩৪ দেশ ভোটদানে বিরত থেকেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বাকি ৩ দেশ নেপাল, ভুটান এবং মালদ্বীপ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোটদাতা হিসেবে ছিল রাশিয়া এবং তার ৬ মিত্র।
বিজ্ঞাপন
ভোটাভুটির পরদিন প্রস্তাবের ক্ষেত্রে ভোটদানে বিরত থাকার পরও বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানায় ঢাকাস্থ রুশ দূতাবাস। যা বাংলাদেশে চলমান বিতর্ককে উস্কে দেয়। মূলত এ কারণেই জাতিসংঘ অধিবেশনে অ্যাবস্টেইনের কারণ ব্যাখ্যা না করলেও ৩ দিনের মাথায় সংবাদ সম্মেলন ডেকে সেগুনবাগিচাকে অনেকটা বাধ্য হয়েই ব্যাখ্যা দিতে হলো। সেই সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে বৈশ্বিক মেরুকরণের মধ্যে ভোটাভুটি এবং সংঘাত বিষয়েও বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করেন মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন।
তিনি বলেন, ইউক্রেন পরিস্থিতিতে অব্যাহতভাবে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ। বিশেষ করে বেসামরিক লোকদের প্রাণহানি, সংঘাতপূর্ণ এলাকায় মানবিক পরিস্থিতির অবনতি এবং এর ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী সামাজিক-অর্থনৈতিক অবনতির ক্ষেত্রে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, আমরা সংঘাত থামানোর আহ্বান জানাই এবং যে কোনো মূল্যে জাতিসংঘ সনদের উদ্দেশ্যে ও মূলনীতিসমূহ রক্ষার বিষয়ে আমাদের প্রতিশ্রুতির বিষয়ে অবিচল রয়েছি।
মুখপাত্র বলেন, ইউক্রেন সমন্বিত, ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই শান্তির পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব ও সদস্য রাষ্ট্রসমূহের পক্ষ থেকে আহ্বানের প্রয়োজনীয়তা আমরা দেখি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আন্তর্জাতিক বিরোধের ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ সমাধান যে কোনো পরিস্থিতিতে কোনো ধরনের ব্যতিক্রম ছাড়াই সার্বজনীনভাবে সবার জন্য অবশ্যই এককভাবে প্রযোজ্য হবে।
সেহেলী সাবরীন বলেন, বঙ্গবন্ধুর ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ আদর্শকে ধারণ করে পরিচালিত হয়ে বাংলাদেশ শান্তিমুখী পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করে থাকে, যা সব দেশের সার্বভৌম সমতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি এবং জাতিসংঘ সনদে থাকা নীতির প্রতি সম্মানের নীতিগুলোর উপর প্রতিষ্ঠিত। ২০২২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর এই পর্যন্ত পাস হওয়া ৪টি প্রস্তাবের একটিতে পক্ষে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশ, যা ছিল মানবিক সহায়তার আবেদন বিষয়ক। বাকিটা সময় ভোটদানে বিরত ছিল ঢাকা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এ ধরনের প্রস্তাব মানতে কোনো দেশ আইনত বাধ্য নয়। তবে, প্রস্তাবের রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে।