আবু সাইদ বিশ্বাস বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা। ২২ লক্ষ জনবসতি সম্পন্ন জেলাটি যাদের হাত ধরে ফুলে ফলে সৌরভ ছড়িয়েছেন তার মধ্যে সাবেক এমপি এম রিয়াছাত আলী বিশ^াস অন্যতম। মুসলিম-হিন্ধু, গরীব-দুঃখী, মেহনতী মানুষের আস্থা ও ভরসার শেয ঠিকানায় পরিণত হয়ে ছিলেন এম রিয়াছাত আলী বিশ^াস। তাঁর অদম্য সাহস, সততা, নীতি, আদশর্, দেশাত্ববোধ ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা, শিক্ষা, খেলাধুলা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবহেলি জেলাবাসির কাছে এক মহান নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। পরিবার থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে তাঁর অনন্য অবদানের কথা দলমত নির্বিশেষে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণে রাখবে। এম রিয়াছাল আলী বিশ^াস সফল কৃতিত্বের গভীরে এক প্রেরণাময় লোভনীয় জীবন উপহার দিয়েছেন। মানুষের হৃদয়ের অকৃত্তিম ভাল বাসার ঝর্নাধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন এম রিয়াছাত আলী। তিনি একাধারে সংগঠক, সমাজ সেবক, জনদরদী, সমাজ হিতোষী, গরীবের বন্ধু সম্বলহীনার অবলম্বন, অসহায়ার সহায়, মানুষ কে কাছে টেনে আপন করে নেওয়ার চুম্বক রশ্মি। শুধু সাদা মনের আলোকিত মানুষই ছিলেন না! তিনি ছিলেন প্রস্ফুটিত গোলাপ, যার সৌরভে আমোদিত হননি এমন মানুষের সংখ্যা খুজে পাওয়া দু:স্করই হবে বলে আমার দৃড় বিশ্বাস। শাহাদাতের প্রেরনায় উজ্জীবিত যে মানুষটি ছিলেন লাখো ফুলের সৌরভে সদা সুরভিত। তাঁর জীবন আলখ্যে কলমের খোচা দিয়ে মালা তৈরি করা সত্যিই এক দূর্লভ প্রয়াস। যার কথা মনে পড়লে আশা- নিরাশায় দোলায় ছন্দ পতন ঢেউয়ের তালে । সঞ্চয় করা সমস্ত শক্তির পুস্পগুলো যেন বারে বারে মুখ থুবড়ে ঝরে পড়ে যায়, অচেনা এক বেদনায়।
দেখতে দেখতে দক্ষিণ বাংলার মহানায়ক এম রিয়াছাত আলীর অনন্তযাত্রার সাতটি বছর গত হয়ে গেল। সময়ের পরিক্রমায় একেবারে কম নয়। উপকূল বাসির শ্রেষ্ঠ সংস্কারক, সুদক্ষ রাষ্ট্রনীতিবিদ, ইসলামী সংগঠনের নির্মাতা, লাখো কোটি মানুষের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি এম রিয়াছাত আলী। ২০১৬ সালের ১০ মার্চ বৃহস্পতিবার বেলা ১০টা ৫৮ মিনিটে বার্ধক্যজনিত কারণে হৃদরাগে আক্রান্ত হয়ে আশাশুনি উপজেলার কুড়িকাউনিয়া গ্রামের নিজ বাড়িতে তিনি ইন্তিকাল করেন। ৮৪ বছর বয়সে তিনি ৩ ছেলে ৫ মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে যান। তার কীর্তি ও কর্ম এ দেশের মানুষের মণিকোঠায় আসন গেড়ে বসে আছে। সময় চলে যাবে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসবে; কিন্তু ইতিহাস জানিয়ে দেবে এ মানুষটির কথা; যিনি পেয়েছিলেন মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা, যার বিনিময়ে তিনি আশাশুনি উপজেলা তথা সাতক্ষীরাকে সাজিয়ে দিয়েছেন উন্নয়ন-সমৃদ্ধি আর সংস্কারের তুলি দিয়ে।
মরহুম এম রিয়াছাত আলীর হাজারো স্মৃতির হাতছানি প্রেরনা দৃপ্ত উত্তাল তরঙ্গ মালাই শুধু সৃষ্টি করেনি, সাথে সম্ভাবনার ঊষঞ্চ আলিঙ্গনে যাদু মাখা পরশ বুলিয়ে দিয়ে ছিলেন সাতক্ষীরা বাসিকে। এক নিগুঢ মাইল ফলক হিসেবে বৈরী, অপ্রিয়, প্রতিকুল আর কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি ময়দানের চ্যালেঞ্জ , মোকাবেলায়ও উদ্দ্যোমী আর সাহসী ভুমিকা পালন করার প্রেরনাও যোগাচ্ছেন।
তিনি এখন তার প্রভু মহানের একান্ত সান্নিধ্যে, স্বর্গের বাগিচায় সবুজ পাখি হয়ে ডানা মেলে উড়বেন এমনটাই আশা করছেন তার ভক্তরা। যিনি সর্বদায় ছিলেন শাহাদাতের তামান্নায় ব্যাকুল, কবির ভাষায় “মরতেই হবে যখন শহিদী মরন দিও আমাকে” যে মৃত্যুর জন্যে তিনি আকাংখিত ছিলেন, যার জন্যে সদা প্রস্তুত ছিলেন, যার মোলাকাতের নেশায় প্রবল পেরেশানীতে উদগ্রীব থাকতেন। যা ছিল মরহুম এম রিয়াছাত আলীর চরম ও পরম পাওয়া।
সাংবাদিক হিসেবে তাঁর জানাজা নামাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে ছিল। সাতক্ষীরা থেকে প্রায় ৫০ কিলো দূরে চারিদিকে পানি বেষ্টিত প্রতাব নগর ইউনিয়ন। কিন্তু সেই দিনের সেই জানাজার কথা আজও স্মরণ রাখারমত। লোকে লোকারন্ন। জানাজায় অংশ না নিয়ে রাস্তার পাশে বসে দু’ চোখের অশ্রুতে বুকভাসিয়ে ফেলতে দেখলাম কয়েকজনকে। জানতে চাইলাম। জানাজায় অংশ না নিয়ে কাঁদছেন কেন। কান্না ভেজা কন্ঠে বললেন, আমরা মুসলিনা। আমরা হিন্দু। বুঝতে বাকি রইল না লোকটা আসলে কেমন ছিলেন।
মরহুম এম রিয়াছাল আলী বিশ^াস কারো নিকট থেকে কখনো কোন ভাল মন্দ কিছু শুনে থাকলে সাথে সাথেই এর প্রতিক্রিয়ায় প্রভাবিত হতেন এবং তাৎক্ষণিক তড়িৎ সিদ্ধান্ত না হলে মনে স্বস্তি পেতেন না। তিনি ছিলেন খুবই আবেগ প্রবন ও সাদা মনের মানুষ। মনটি ছিল তাঁর যেন একেবারেই কচিপাতা, একটু তাপেই গলে যাওয়ার মত। কমলতায় এতখানি আবেগে আপ্লত হয়ে যেতেন যে, শর্মিলতায় একটু খানি ছোঁয়া লাগলে যেমনটি হয়ে থাকে। তবে তাঁর হৃদয় ছিল সাগরের ন্যায় বিশাল, দিগন্ত জোড়া দু’বাহুর উষ্ণ আলিঙ্গনে তপ্ত মরুমনকে ভিজিয়ে দিতেন, আকর্ষণীয় স্নিগ্ধ মধুর ব্যবহারে, যার কারনে সাধারন খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ, দিন মজুর, শ্রমিক কুলিরা সবচেয়ে অধিক শোকাহত ছিলেন তার মৃত্যুতে।
মাওলানা এম রিয়াছাত আলী বিশ্বাস ১৯৩৭ সালে ২৮ ডিসেম্বর আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া গ্রামের এক সমভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মৃত জনাব আলী বিশ^াস ও মাতা মৃত রাহিলা খাতুন।
ছাত্র জীবন : মাওলানা এ এম রিয়াছাত আলী বিশ্বাস ১৯৪৬ সালে শ্যামনগর উপজেলার পাতাখালী মাদরাসা থেকে ৮ম শ্রেণী ও ১৯৪৮ সালে একই মাদরাসা থেকে দাখিল পাস করেন। ১৯৪৮ সালে বাগেরহাট জেলার সোনাতুনিয়া ফাজিল মাদরাসা থেকে আলিম ও ফাজিল পাস করেন। তিনি ১৯৫৪ সালে বরিশাল শরশিনা কামিল মাদরাসা থেকে হাদিসের ওপর কামিল ডিগ্রি অর্জন করেন।
রাজনৈতিক জীবন : মাওলানা এ এম রিয়াছাত আলী বিশ^াস ১৯৫৮ ও ১৯৬৩ সালে প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য এবং ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে তিনি রাষ্ট্রীয় স্বর্ণ পদক লাভ করেন। তিনি ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মনোনয়নে সাতক্ষীরা-৩ (আশাশুনি) আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য ও ২০০১ সালে চার দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে একই আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় তিনি বাংলাদেশ সরকারে অর্থ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং বাচাইকৃত ৪ সদস্য বিশিষ্ট্য কমিটির চেয়ারম্যান থাকাকালীন বাংলাদেশ র্যাব বাহিনী গঠনের অন্যতম প্রস্তাবক ছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালে তৎকালীন সরকারের বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।
১৯৫৮-হতে -১৯৬৪ পর্যন্ত প্রতাপনগর মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাত প্রিন্সিপাল, ১৯৬৫-১৯৬৮ ঘুগরাকিট ফাজিল মদ্রাসার প্রিন্সিপাল ১৯৬৮-১৯৭১ পর্যন্ত প্রতাপনগর হাইস্কুলের ইংরেজি শিক্ষক ১৯৭৩-১৯৭৭ ঘুগরাকটি ফাজিল মদ্রাসার প্রিন্সিপাল ১৯৭৭-১৯৯৩ পর্যন্ত আবার প্রতাপনগর ফাজিল মদ্রাসার প্রিন্সিপাল দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি সংসদ থাকা কালিন আশাশুনি উপজেলা উপজেলা পরষিদ ভবন, হাসপাতাল ভবন, বিভাগীয় এতিম কমপ্লেক্স নির্মাণ করেন। তাঁর ছেলে আফসার উদ্দীন জানান, জাতীয় সংসদ সদস্য হওয়ার পর তার বাবা কোন সম্পদ বানাতে পারেননি। চেয়াম্যান থাকা কালিন প্রজেক্টের চাল বেচে গেলে তা সম্পূর্ন সরকারের কোষাগারে জমা দিতেন। তাই চেয়ারম্যান থাকা কালীন তখনকার প্রেসিডেন্ট তাকে ডেকে নিয়ে পুরুস্কৃত করেন এবং প্রেসিডেন্ট নিজ হাতে ডাব কেটে খাওয়ায়ে বলেন আপনার মত চেয়ারম্যানরা এ জাতীর জন্য গর্ব। তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার পরও তার বসত বাড়ি থেকে গেল গোলের ছাউনি। বিলসিতা দুরে থাক, তার বেতন ভাতার অধিকাংশ খরচ করতেন এলাকার উন্নয়নের পিছনে ছোটা-ছুটিতে, গরিব দুঃখির মাঝে ও ইসলামী আন্দোলনের পিছনে। প্রজেক্টের কমিশন দুরে থাক, সমান্যতম অবৈধ অর্থ বা সম্পদ তাকে কোন দিন স্পর্শ করতে পারেনি।
আর সবকিছুর ঊর্ধ্বে এম রিয়াছাত আলী বিশ^াস ছিলেন একজন ভালো মনের মানুষ, যার ছিল এক বিশাল হৃদয়; যে হৃদয় দিয়ে তিনি উপলব্ধি করতে পারতেন মানুষের দুঃখ-দুর্দশা-হাসি-কান্না-আনন্দ-সুখ-সৃষ্টি-উল্লাস-ব্যথা-বেদনা-প্রেম-ভালোবাসা ও লীলাময় প্রকৃতির বিচিত্র অনুভূতি। তার ছিল বর্ণময় জীবন ও জীবনের অপূর্ব দর্শন। সে দর্শনের একটি দিক হচ্ছে, রাজনীতির কঠিন-জটিল অঙ্কের সরল সমাধান। ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার মতো তিক্ততা ও মিষ্টতার সমন্বয় ঘটানোর অভিজ্ঞতা।তাঁর স্বপ্ন ছিল ইসলামী সমাজ বিনির্মানের মধ্য দিয়ে গরীব-দু:খী মেহনতি মানুষ, অধিকার হারা বঞ্চিত, অবহেলিত, নির্যাতিত নিষ্পেসিতদের মুখে হাসি ফোটানো। মরহুম এম রিয়াছাত আলী বিশ^াস আমৃত্যু মানুষের মাঝে প্রেরনার বাতিঘর হিসাবে চির অম্লান হয়ে থাকবেন ইনশাআল্লাহ।
আবু সাইদ বিশ্বাস
লেখক ও সাংবাদিক