শেষ পর্যন্ত জাপা কী করবে?

পার্টি চেয়ারম্যানের বিষয়ে আদালতের নির্দেশনায় চার মাস প্রায় স্থবির ছিল জাতীয় পার্টি। এই স্থবিরতা এখন আর নেই। কিন্তু আছে দোটানার চাপ। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে জাতীয় পার্টিতে এই চাপ ক্রমে ঘনীভূত হচ্ছে। বিগত দুই নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। ক্ষমতার রাজনীতির নির্ণায়কের ভূমিকা নিয়েছিল। এবার দলটির অবস্থান কী হবে সেই প্রশ্ন রাজনীতির মাঠে। প্রশ্ন আছে আমজনতার মাঝেও। শেষ পর্যন্ত কী করবে জাপা? এমন নানা প্রশ্ন ক্রমে জোরালো হচ্ছে। নানা কারণে এখন দলটির নেতাকর্মীরাও বিভ্রান্ত।

 

সময়ে সময়ে দলীয় দ্বন্দ্ব সামনে আসে। পরে অবশ্য ঐক্যের কথা বলা হয়। নেতাকর্মীদের অনেকে বলছেন, আসলে এই ঐক্য এক ধরনের মেকাপ ঐক্য। দলে পুরোমাত্রায় দুটি ধারা বিদ্যমান। একটি পক্ষ দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বাইরে বলয় তৈরির চেষ্টা করছে। তারা দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে। অন্যদিকে জিএম কাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালনা ও নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে চান। এভাবে দল পরিচালনা করলে বিপরীত ধারার নেতাদের কর্তৃত্ব হুমকির মুখে পড়বে এমন আশঙ্কা থেকেই তারা নানা সময়ে নানা তৎপরতা চালান। পার্টি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা, সময়ে সময়ে সম্মেলন, কমিটি গঠনের মতো কাজেও নেপথ্য ভূমিকা রাখেন এসব নেতা।
জাতীয় নির্বাচনের আগে দলীয় ঝামেলা নিয়েই ভুগছে জাতীয় পার্টি। দৃশ্যত ঐক্যের কথা বলা হলেও দলীয় মেরূকরণ এখনো থেমে নেই। বরং তা আরও জোরালো হচ্ছে। এমন অবস্থায় জাতীয় পার্টি জাতীয় নির্বাচনের আগে একক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে কিনা এ নিয়ে সংশয়ে আছেন দলটির নেতাকর্মীরা। দলীয়ভাবে বলা হচ্ছে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। তবে তিনশ’ আসনে প্রার্থী দেয়ার মতো অবস্থান দলটির নেই। প্রার্থী দেয়ার বিষয়টি নির্ভর করে মূলত নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। নেতারা বলছেন, তখনকার পরিস্থিতিই জাতীয় পার্টির অবস্থান নির্ধারণ করে দেবে। জাতীয় পার্টি আগের মতো ক্ষমতা নির্ধারণী অবস্থানে থাকতে পারে। বিরোধী শিবিরের সঙ্গে প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারে।
আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে দীর্ঘ চার মাস বিরতি দিয়ে গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি দলের বনানীস্থ কার্যালয়ে কো চেয়ারম্যান, প্রেসিডিয়াম ও সংসদ সদস্যদের নিয়ে পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদের একটি যৌথ সভা করেন। সভায় ছিলেন না জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। তবে তার ছেলে সংসদ সদস্য রাহগীর আল মাহি (সাদ এরশাদ) উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেখানে বক্তৃতাও দিয়েছেন। ওই বৈঠকের পর দলীয় একটি সূত্র দাবি করে বৈঠকে সাদ এরশাদের উপস্থিতি ছিল বিশেষ উদ্দেশ্যে। রওশন এরশাদপন্থি নেতারা চাইছেন ঐক্যের নামে জিএম কাদেরকে নতুন করে কোণঠাসা করতে। জিএম কাদেরকে বিভিন্ন শর্ত দিয়ে তাদের ওপর থেকে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করাতে চান তারা। জাপার বৈঠকে এই বিষয়ে আলোচনাও হয়েছে। যারা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন তাদেরকে রেখে অন্য নেতাদের পর্যায়ক্রমে ক্ষমা করার অনুরোধ করেছেন অনেক নেতা।

দলীয় সূত্র জানায়, জিএম কাদের যাদের অব্যাহতি দিয়েছেন তারাই এখন নেপথ্যে থেকে নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন। কারণ জিএম কাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাদের বহিষ্কার করেছেন। দল ক্ষমা না করলে তাদের আর রাজনীতি করার সুযোগ থাকে না। জিএম কাদেরের ওপর চাপ দিতে এসব বহিষ্কৃত নেতারা কাউন্সিল ডাকার চিন্তা করছেন বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে।
এই বিষয়ে জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএমএম আলম মানবজমিনকে বলেন, দল থেকে বহিষ্কার হওয়া নেতাকর্মীদের দলে ফিরিয়ে নেয়ার কথা ছিল জিএম কাদেরের। গত ২১শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে বহিষ্কৃত সব নেতাকর্মীদের দলে ফিরিয়ে নিয়ে পদ-পদবি সমন্বয় করার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে জিএম কাদেরকে আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছিল। জিএম কাদের আমাদের কথা রাখেননি। সূত্র জানায়, বেগম রওশন এরশাদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, সাদ এরশাদকে নির্বাহী সভাপতি এবং গোলাম মসীহকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করে ২১ জনের একটি কমিটি করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন বহিষ্কৃত নেতারা।
যদিও এমন তৎপরতাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেন, জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ আছে।

জাপার একাধিক সূত্র জানায়, যৌথ সভায় জাপার সাবেক মহাসচিব ও প্রেসিডিয়াম সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা ও চেয়ারম্যানের সাবেক উপদেষ্টা জিয়াউল হক মৃধার বিষয়ে একাধিক নেতা কথা বলেছেন। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীরা যেন মাফ না পায় তার সুপারিশও করেছেন অনেকে। এই বিষয়ে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার মানবজমিনকে বলেন, রাজনীতিতে কেউ চিরশত্রু বা চিরবন্ধু নয়। আওয়ামী লীগের এমন কিছু নেতাকর্মী ভুল-ত্রুটি করেছিলো। প্রধানমন্ত্রী তাদের ক্ষমা করে আবার দলে নিয়েছেন। এখন কাদের নেয়া হবে আর হবে না তা জাপা চেয়ারম্যান জানেন।

দলীয় পরিকল্পনার বিষয়ে নেতারা জানিয়েছেন, নির্বাচনকে ঘিরে জাতীয় পার্টি বিভিন্ন জেলার সম্মেলন শেষ করবে। এরপর কাউন্সিলও করার সিদ্ধান্ত রয়েছে জিএম কাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির। এই বিষয়ে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, বৈঠকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামী জুন মাসের মধ্যে জেলা সম্মেলন শেষ করবো। আগামী নির্বাচনের আগে আমরা চেষ্টা করবো, দলের কাউন্সিল করার। জুলাইয়ের পরে আমরা কাউন্সিল করতে পারি। ঈদের পরে আমরা প্রতিটি বিভাগে গণসংযোগের জন্য একটি করে বড় সমাবেশ করবো। সমাবেশগুলো যেন ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারি এজন্য আমাদের নানা কার্যক্রম থাকবে।

যৌথ সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক নেতা জানিয়েছেন, সভায় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি জাপা নেতাদের আস্থা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে জাতীয় পার্টি বিশ্বাস করে না- সভা শেষে সাংবাদিকদের একথা বলেন জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। কী কারণে জাতীয় পার্টি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিশ্বাস করে না- এমন প্রশ্নের জবাবে রুহুল আমিন হাওলাদার মানবজমিনকে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে আমরা নিরপেক্ষতা পাইনি। তারা আমাদের নির্বাচন করতে দেয়নি, এরশাদ সাহেবকে তার বক্তব্য রাখতে দেয়া হয়নি। সরকার প্রধান হিসেবে যে সহযোগিতা করার কথা ছিল তা আমাদের করা হয়নি। তবে আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে।

দলটির নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, জিএম কাদের দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলছেন। এতে নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হচ্ছেন। সাধারণ মানুষও এতে আশান্বিত। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনের সময়ে দেশ, মানুষ এবং দলের স্বার্থ রক্ষা করেই জিএম কাদের যথাযথ সিদ্ধান্ত নেবেন।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।