প্রকল্পের ঋণ বাতিলের ক্ষমতা চায় চীন

রাজশাহী ওয়াসার একটি প্রকল্পের ঋণে কঠিন শর্ত দিয়েছে চীন। প্রকল্প চলাকালে চীনের নীতিমালায় কোনো পরিবর্তন হলে শর্ত ছাড়াই নোটিশ দিয়ে সম্পূর্ণ অর্থায়ন বাতিলের ক্ষমতা চায় দেশটি। সেই সঙ্গে উচ্চ প্রতিশ্রুতি ও ব্যবস্থাপনা ফি, কম ম্যাচুরিটি ও সহজলভ্য পিরিয়ড সংক্রান্ত শর্তও দিয়েছে। তারা বলেছে অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে চীনা আইন। যে কোনো সালিশ নিষ্পত্তি হবে বেইজিংয়ে। চীনের এসব প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ বিষয়ে চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি)।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইআরডির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বুধবার যুগান্তরকে বলেন, চীনা ঋণের শর্ত সবসময়ই কঠিন হয়। শুধু এ প্রকল্পের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তারা এসব শর্ত চাপিয়ে দিতে চায়। পরবর্তীতে আলাপ-আলোচনার পর কিছু ক্ষেত্রে সমঝোতা হলেই কেবল ঋণ চুক্তি হয়। রাজশাহী ওয়াসার ঋণের শর্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইআরডির পক্ষ থেকে চীনকে বাংলাদেশের আপত্তির বিষয়গুলো জানানো হয়েছে। তবে তাদের (চীনের) দিক থেকে এখনো কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

সূত্র জানায়, ‘রাজশাহী ওয়াসা সার্ফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’ শীর্ষ প্রকল্পের জন্য ২৭ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ চাওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ দিতে সম্মতি জানিয়ে গত ১৬ জানুয়ারি একটি ঋণচুক্তির খসড়া পাঠায় চীন। প্রিফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের (পিবিসি) ঋণ চুক্তি খসড়াটির ওপর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা। ইআরডির অতিরিক্ত সচিব ও অনুবিভাগ (এশিয়া, জেইসি ও বৃত্তি) প্রধান শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী সভায় সভাপতিত্ব করেন। এতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা মতামত তুলে ধরেন। গত ৭ মার্চ জারি করা হয়েছে সভার কার্যবিবরণী। এরপরই চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশ মতামত জানিয়ে প্রস্তাব দিয়েছে ইআরডি।

সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে ১৪ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরের সময় স্বাক্ষর হয় ‘স্ট্রেনদেনিং ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড প্রডাকশন ক্যাপাসিটি কোঅপারেশন’ শীর্ষক এমওইউ। সেখানে রাজশাহী ওয়াসার প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত আছে। পরবর্তী সময়ে আরও আলাপ-আলোচনার পর এ প্রকল্পে ঋণ দেওয়া বিষয়টি এগিয়ে যায়। চীনের পাঠানো ঋণ চুক্তির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ঋণের সুদের হার হবে ২ শতাংশ। ব্যবস্থাপনা ফি হিসাবে এককালীন দিতে হবে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ অর্থ। এছাড়া প্রতিশ্রুতি ফি হিসাবে ছাড় না হওয়া অর্থের ওপর বাৎসরিক শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ দিতে হবে। কিন্তু এসব বিষয়য়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বলা হয়, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় ব্যবস্থাপনা ও প্রতিশ্রুতি ফি কমানো দরকার। কেননা দ্বি-পাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণে কোন কমিটমেন্ট ফি নেই। ভারতের কমিটমেন্ট ফি মোট অছাড়কৃত অর্থের ওপর ধার্য না করে পৃথক প্যাকেজভিত্তিক ধার্য করা হয়। বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে বিশ্বব্যাংক এই ফি নিচ্ছে না। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে আছে মাত্র শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ। সেইসঙ্গে অধিকাংশ উন্নয়ন সহযোগীর ঋণে ব্যবস্থাপনা ফি নেই। কোনো ঋণে থাকলেও তা অত্যন্ত কম। চীনের প্রস্তাবিত ঋণে ম্যাচুরিটি পিরিয়ড হিসাবে ২০ বছর ধরা হয়েছে। কিন্তু জাপানের ম্যাচুরিটি পিরিয়ড ৩০ বছর, দক্ষিণ কোরিয়ার ৪০ বছর। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের ৩০-৩৮ বছর এবং এডিবির ২৫ বছর। ফলে চীনা কর্তৃপক্ষকে ম্যাচুরিটি পিরিয়ড আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে ২৫ বছর করার প্রস্তাব দিতে হবে।

সূত্র আরও জানায়, খসড়া ঋণ চুক্তিতে গ্রেস পিরিয়ড (রেয়াতকাল) এবং অ্যাভেইলিভিলিটি (সহজলভ্যতা) পিরিয়ড উভয়ই ৬০ মাস ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে সময় বাড়িয়ে ৭২ মাস করার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। খসড়া ঋণ চুক্তি আর্টিকেল-৭ ধারা অনুযায়ী চীনা কর্তৃপক্ষের কোনো পলিসিগত পরিবর্তনের ফলে কোনো শর্ত ছাড়াই নোটিশ দিয়ে প্রকল্পে অর্থায়ন সম্পূর্ণরূপে বাতিল করতে পারবে বলে উল্লেখ রয়েছে। এটি নেগোশিয়েশনের মাধ্যমে সুরাহার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইআরডিকে।

আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় রাজশাহী ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাকীর হোসেন বলেন, খসড়া ঋণ চুক্তি আর্টিকেল ৭-এর মধ্যে শুধু বাংলাদেশের পক্ষের বিভিন্ন ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনা কর্তৃপক্ষেরও ত্রুটি হতে পারে। যেমন-কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো বিষয় চীনা পক্ষের কাছে দীর্ঘদিন পড়ে থাকে। তাদের পক্ষে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। এর ফলে আর্থিকভাবে আমাদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।

চীনের পাঠানো খসড়া ঋণ চুক্তিতে আরও বলা হয়, উভয় পক্ষের অধিকার ও বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে চীনা আইন প্রযোজ্য হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পক্ষের জন্য বাংলাদেশের আইন প্রযোজ্য হওয়া বিষয়টি উল্লেখ থাকা প্রয়োজন বলে সভায় মতামত দেওয়া হয়। এ ঋণ চুক্তি ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কোনো বিষয়ে সালিশের জন্য নির্ধারিত স্থান হিসাবে বেইজিং উল্লেখ করা হয়েছে খসড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশ মনে করে স্থানটি চুক্তিকারী দেশের বাইরে তৃতীয় কোনো দেশ হওয়া উচিত।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।