কোনো কিছু কি আসলে ফাঁস করলেন ড. আবদুল মোমেন? কেন করলেন?
না-কি বেফাঁস কিছু বললেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী?
দেশের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে তাঁর চাইতে বড় ‘আইটেম’ কি আর আছে?
আবদুল মোমেন কি বুঝেশুনে সব করেছেন? কোনো অভিসন্ধি? না-কি অপরিপক্ব রাজনৈতিক জ্ঞান? জাতীয়, আন্তর্জাতিকভাবে সরকার ও আওয়ামী লীগকে কত বড় বিতর্কে ফেললেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী? আবদুল মোমেন কি আওয়ামী লীগের সম্পদ? না-কি বোঝা?
বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ‘যা যা করা দরকার’ তা-ই ভারতকে না-কি অনুরোধ করেছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বোঝেন ঠ্যালা! সরকার টিকে থাকবে না-কি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হবে তা-কি অন্য কোনো দেশ ঠিক করবে? দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই কথা বলতে পারেন? কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিক এ কথা কীভাবে বলেন?
গত বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) চট্টগ্রাম শহরে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে আবদুল মোমেন প্রকাশ্যেই বললেন, ‘দুই দেশেরই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। এটি সম্ভব যদি শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন দেয় ভারত; পররাষ্ট্রমন্ত্রী নির্দ্বিধায়ই বললেন, ‘অনেকে আমাকে ভারতের দালাল বলে, কারণ অনেক কিছুই হয়, আমি স্ট্রং কোনো স্টেটমেন্ট দিই না।’
তোতা পাখির মতো কারও শিখিয়ে দেওয়া কথা বলবেন এত সরল আর সোজা নিশ্চয়ই পররাষ্ট্রমন্ত্রী নন! জাতীয় আর আন্তর্জাতিকভাবে তাঁর কর্মস্থল, যাদের সাথে তিনি কাজ করেছেন তাদের পরিচয়ই বলে দেয় আবদুল মোমেন ‘জটিল’ কিছু শিখেছেনও। তাঁর জীবন বৃত্তান্ত বলছে এক সময় (১৯৭৩-৭৪) তিনি দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। ওই বাণিজ্যমন্ত্রী কি খন্দকার মুশতাক? না-কি অন্য কেউ? পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জীবন বৃত্তান্তে অবশ্য পরিষ্কার কিছু বলা নেই। তবে একাধিক মন্ত্রীর পিএস-এর দায়িত্ব সামলানো আবদুল মোমেন যে মুখ ফসকে কিছু বলবেন এতটা অপরিপক্বও কি তাঁকে ভাবা ঠিক হবে?
চারদিকেই এখন প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে ভারতই কি সরকার টিকিয়ে রাখে কি-না? বিষয়টি সরকারের জন্য নিঃসন্দেহে অস্বস্তির। এই মন্তব্য অবশ্যই অনভিপ্রেত। দেশের সার্বভৌমত্বকেই চ্যালেঞ্জ করার শামিল।
আমরা দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য দেশের ভেতরে যে ‘ভারত বিরোধী শক্তি’ তাদের জন্য এক উপাদেয় রসদ। তিস্তা পানি চুক্তি না হওয়াসহ বেশ কিছু অমীমাংসিত ইস্যু বাংলাদেশ-ভারতের রয়েছে। আবদুল মোমেনের এই বালখিল্যসুলভ অবাঞ্ছিত মন্তব্য গোটা পরিস্থিতিকে কি আরও জটিল করে তুলবে না?
এমনিতেই বাংলাদেশের সর্বশেষ দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগের অন্ত নেই। সুযোগ পেলেই প্রধান প্রধান বিরোধী দলগুলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের পাশাপাশি ভারতকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। বিশেষ করে ২০১৪ সালে যখন নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল তখন ভারতের ভূমিকা নিয়ে এখনো আঙুল তোলে বিরোধীরা। এই সুযোগ বিরোধীরা এ জন্য পায় যে, ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং তখন বাংলাদেশ সফর করেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের সাথে তাঁর কথা হয়। এর আগ পর্যন্ত নির্বাচনে যেতে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টি ইউটার্ন নিয়ে নির্বাচনে যেতে রাজিও হয়। অবশ্য এরশাদ দাবি করেন, ভারত তাঁকে জোর করে নির্বাচনে যেতে রাজি করিয়েছে। পরবর্তীতে আমাদের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভারতের সুদৃঢ় অবস্থান অবশ্যই সরকারের পক্ষেই ছিল। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে রাখঢাক না রেখে বললেন, তা সকল কূটনৈতিক, রাজনীতি, শিষ্টাচার তছনছ করে দিয়েছে।
আবদুল মোমেনের এই বক্তব্যে অস্বস্তিতে পড়ার কথা ভারতেরও। সেই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বিতর্ক তৈরি হওয়ার কথা। কারণ এখানে স্পষ্টভাবেই ভারতের ভাবমূর্তিও জড়িত। অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত নাক গলায় কি গলায় না সেই ব্যাখ্যা দেওয়ার একটি দায়ও সৃষ্টি করে দিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এটা কি দুই দেশের সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা নয়?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত যেভাবে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে, শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে সহযোগিতা করেছে তা অতুলনীয়। বাংলাদেশের মানুষ সব সময় কৃতজ্ঞচিত্তে তা স্মরণ করে। তবে এই সমর্থন, সহযোগিতা ছিল বন্ধুত্বের নিদর্শন। কোনো শর্ত সাপেক্ষে ওই সমর্থন দেওয়া হয়নি। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করিয়েছিলেন। একটি বার্তাও দিয়েছিলেন যৌথ নদীর ন্যায্য হিস্যা দাবি করে। কোনো আপত্তিকে গ্রাহ্য না করে ইসলামি সম্মেলনে (ওআইসি) যোগও দিয়েছিলেন।
এসবই মোমেন সাহেবের জানা থাকার কথা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই অতিমাত্রায় অন্য রাষ্ট্রপ্রীতির বিষয়টি কিন্তু দেশের নাগরিকেরা কোনোভাবেই ভালো চোখে দেখছে না।
খোঁজখবর নিতে গিয়ে আবদুল মোমেন সম্পর্কে যা জেনেছি তা খুব স্বস্তিদায়ক কিছু নয়। ইনি তো সেই যাকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করা আওয়ামী লীগ সরকার (২০০৯) সৌদি আরবে রাষ্ট্রদূত করার প্রস্তাব করে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা জানাচ্ছেন, মোমেনকে রাষ্ট্রদূত করতে যে এগ্রিমো পাঠানো হয়েছিল তা অনুমোদন করেনি সৌদি আরব। পরবর্তীতে তাঁকে জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি করা হয়। কিন্তু কেন সৌদি আরব ব্যক্তি মোমেনের প্রতি নাখোশ সেই কারণটি এখন সামনে আসা জরুরি।
আর বাংলাদেশের এক নম্বর শ্রমশক্তি যে দেশে রপ্তানি হয় সেই দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টাই বা তাহলে কীভাবে করছেন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী? কেন, কোন পরিস্থিতিতে তিনি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন? আমরা কি কোনো দিন এসব জানতে পারব?
কোনো দিন কি এর সুস্পষ্ট জবাব মিলবে যে মন্ত্রী হয়ে ভারত সফরে গিয়েই বছর তিনেক আগে কেন আবদুল মোমেন বলেছিলেন, বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো? নিজের বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়ে কেনই বা তিনি ‘বেহেশত’ তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন? এসব বিতর্ক তৈরি কি অনিচ্ছাকৃত? না-কি বুঝেশুনে? না-কি রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব?
মোমেন আওয়ামী লীগের কেউ না বলে কি দায় এড়ানো যাবে? মন্ত্রীর বক্তব্য তার একান্তই ব্যক্তিগত বললেও দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা রাজনৈতিক বিতর্ক নিভে যাবে?
আবদুল মোমেনরাই এখন সরকারের ভেতর শক্তিশালী। আর এঁরাই সরকারকে একের পর এক বিতর্কে ফেলছেন।
বিষয়টি কি শুধুই কাকতালীয়!
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম ও সাপ্তাহিক এই সময়