॥ আব্দুল ওয়াদুদ সরদার ॥
ঈদুল ফিতর মুসলিম উম্মাহর জীবনে এক অনন্য সৌন্দর্যের প্রতীক, জাতীয় সাংস্কৃতির চেতনায় ইসলামী শরিয়তের প্রধান উৎসব। এ উৎসব পালনের মাধ্যমে জাতিগতভাবে মুসলিম জনগণ নিজেদের অস্তিত্বের প্রমাণ উপস্থাপিত করে থাকে। গরিব, ধনী, আত্রাপ, আশরাফ সকল ভেদাভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলে ঈদের সালাত জামাতে আদায় করে উৎসব ভাগাভাগির মাধ্যমে উপভোগ করে থাকে। প্রতি বছর ঈদের এ আমেজ মুসলিম জাতিসত্তাকে উদ্বেলিত করে যথাযথ পালনের মাধ্যমে তাকওয়া ও আত্মসংযমশীলতা অর্জনে সক্ষম তারাই, যারা মূলত এ আনন্দ খুশি ও ভালোবাসার উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করতে চায়।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বিশ্ববাসীর জীবন পরিচালনার জন্য তাঁর সকল বিধিবিধান সংবলিত মহাগ্রন্থ আল কুরআন মানবজাতির কল্যাণে নাজিল করেছেন মাহে রমজানের শেষ দশকে। কোন পথে চললে কল্যাণ, কোন পথে চললে অকল্যাণ হবে সবই সন্নিবেশিত করেছেন তিনি এ গ্রন্থে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা.-এর ওপর নাজিলকৃত আল কুরআনের এ হুকুম তিনি নিজে ২৩ বছর জিন্দেগিতে পালন করে মানবজাতির জীবন চলার পথ বাতলে দিয়েছেন। যেগুলো সিয়াসিত্তাহ হাদীস গ্রন্থসহ বিভিন্ন কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। রাসূল সা. রমজান মাসে মাতৃভূমি মক্কা থেকে বিতাড়িত হয়ে গুটি কয়েক সাহাবী সাথে নিয়ে মদীনায় হিজরত করেন এ রমজান মাসে। অতঃপর তিনি কাফির, মুশরিক ও মুনাফিক-এর বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বদরে ১৭ রমজান বিজয় লাভ করেন। এ সময় মদীনায় উদযাপিত জাহেলিয়াতের আনন্দ উৎসবের রীতিনীতি বদলিয়ে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে সর্বজনীন নমুনা উপস্থাপনের ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাপী আজ উদযাপিত হচ্ছে মুসলিম জাতির এ ঈদ উৎসব, যা প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে মুসলিম জাতিকে আন্দোলিত ও ঐক্যবদ্ধ করে।
‘ঈদ’ আরবি শব্দ, যা ‘আওদ’ শব্দ থেকে উৎপত্তি। এর শাব্দিক অর্থ ঘুরে ঘুরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা। প্রচলিত অর্থে ঈদ মানে আনন্দ বা খুশি। এ আনন্দ বছর পরিক্রমায় মুসলিম জাতির মাঝে ফিরে আসে বিধায় এর নামকরণ করা হয় ঈদ। যেসব আনুষ্ঠানিক উৎসব মুসলিম জাতির অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে ‘ঈদ’ তার মধ্যে অন্যতম। জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনায় প্রধান উৎসব হিসেবে পালিত হয় এ মহান দুটি ঈদ উৎসব ‘ঈদুল ফিতর’ ও ‘ঈদুল আজহা’।
ঈদের সূচনা যেভাবে
ইসলামের ইতিহাস গবেষণার মাধ্যমে জানতে পারি, মদিনার জাহেলি যুগে শরতের পূর্ণিমায় ‘নওরোজ’ এবং বসন্তের পূর্ণিমায় ‘মেহেরজান’ নামে দু’টি উৎসব পালন করত। যেটি ইসলামের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যহীন। এ ব্যাপারে হজরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, ‘‘মহানবী সা. ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হিজরত করে পবিত্র মক্কা নগরী থেকে মদীনা মনাওয়ারায় এসে দেখতে পারেন সেখানকার অধিবাসীরা বছরে দুদিন খেলাধুলা ও আনন্দ উৎসব পালন করে থাকে। এটি দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এ দুদিন কীসের? সাহাবাগণ বললেন, জাহেলি যুগে আমরা এই দুই দিবসে খেলাধুলা বা আনন্দ প্রকাশ করতাম। অতঃপর রাসূল সা. বলেন, আল্লাহ তায়ালা এ দিন দুটির পরিবর্তে তা অপেক্ষা উত্তম দুটি দিন তোমাদের খুশি প্রকাশ করার জন্য দান করেছেনÑ এর একটি হচ্ছে ‘ঈদুল ফিতর’ এবং অপরটি হচ্ছে ‘ঈদুল আজহা’। তখন থেকেই ইসলামী শরিয়তে দু’টি ঈদ আনুষ্ঠান পালিত হয়ে আসছে।
ঈদের পরিচিতি
সর্বাধিক মহিমান্বিত ও সাওয়াবে ভর্তি পবিত্র মাহে রমজান, যার মধ্যে নিহত রয়েছে মহিমান্বিত শবেকদরের রজনী। এরপরই চন্দ্র বর্ষের দশম মাসের সূচনার দিনেই শাওয়াল মাস আগমনের বার্তায় বাঁকা চাঁদ মুসলিম উম্মাহর জন্য বয়ে আনে এক আনন্দ উৎসব। দীর্ঘ এক মাস পবিত্র সিয়াম সাধনার মাধ্যমে সকল পাপ-পঙ্কিলতা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধুয়ে মুছে তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত হয় আল্লাহর মুমিন বান্দাগণ। শাওয়ালের প্রথম দিনে ইসলামী শরিয়তের প্রণেতা মহানবী সা. মুসলিম জাতির জন্য যে উৎসব নির্ধারণ করেছেন তাই হচ্ছে ‘ঈদুল ফিতর’। অপরদিকে চন্দ্র বছরের জিলহজ, মাসের দশম তারিখে পশু জবেহ করার মাধ্যমে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে যে উৎসব পালন করা হয়, তা হচ্ছে ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ। উভয় ঈদের ঘোষণা মহানবী হজরত মুহাম্মদ স. দ্বিতীয় হিজরী সনে জারি করেন।
ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য
নানা দিক দিয়ে ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য অপরিসীম। এ সম্পর্কে মহানবী সা.-এর বাণী প্রণিধানযোগ্য। তিনি এরশাদ করেন, ‘‘যখন ঈদুল ফিতরের দিন আসে, তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যারা রোজা পালন করেছে; তাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের নিকট গৌরব করে বলেন, ‘‘হে আমার ফেরেশ্তাগণ, তোমরা বল তো! যে শ্রমিক তার কাজ পুরোপুরি সম্পাদন করে তার প্রাপ্য কী হওয়া উচিত? উত্তরে ফেরেশতাগণ বললেন, হে মাবুদ! পুরোপুরি পারিশ্রমিকই তার প্রাপ্য। ফেরেশতাগণ! আমার বান্দা-বান্দীগণ তাদের প্রতি নির্দেশিত ফরজ আদায় করেছে, এমনকি দোয়া করতে করতে ঈদের ওয়াজিব সালাতের জন্য বের হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় আমার মহিমা, গরিমা, উচ্চমর্যাদা ও উচ্চাসনের শপথ, আমি অবশ্যই তাদের ইবাদতে সাড়া দেব। এরপর নিজ বান্দাগণকে লক্ষ করে আল্লাহ পাক ঘোষণা দেন; তোমরা ফিরে যাও, ‘আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম এবং তোমাদের সাধারণ পাপরাশিকে পুণ্যে পরিণত করে দিলাম। প্রিয়নবী সা. বলেন, তখন তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত অবস্থায় (বাড়িতে) প্রত্যাবর্তন করে।’
কারণ রমজানের শেষ দশকে শবেকদরে আল্লাহর মুমিন বান্দাগণ আল্লাহর কাছে তাওবা ইস্তেগফারের মাধ্যমে এভাবে ফরিয়াদ করেছে- ‘হে মালিক! আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমাকে পছন্দ করেন, আমাকে ক্ষমা করে দিন’।
ঈদুল ফিতরের ফজিলত ও তাৎপর্য সম্পর্কে হজরত সাঈদ আনসারী রা. থেকে বর্ণিত। নবী করীম স. এরশাদ করেন, ঈদুল ফিতরের দিনে আল্লাহর ফেরেশতাগণ রাস্তায় নেমে আসেন এবং অলিগলিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, হে মুসলমানগণ! তোমরা আল্লাহর দিকে দ্রুত ধাবিত হও। তিনি তোমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইবাদত কবুল করে অসংখ্য পুণ্য দান করে থাকেন। তোমাদেরকে রোজা রাখার আদেশ করা হয়েছিল, তোমরা তা পালন করেছো যথাযথভাবে। রাতেও জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত করেছো। অতএব যাও, তাঁর নিকট থেকে গ্রহণ কর তোমাদের ইবাদতের প্রতিদান। (তাবরানী)।
ঈদ শুধু আনন্দই নয়, ইবাদতও বটে, হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ পাকের বাণী- ‘রোজা আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব’। ঈদের দিনে আল্লাহ তায়ালার এ ঘোষণা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ঈদ শুধু আনন্দই নয়, ইবাদতও বটে। এ প্রসঙ্গে হজরত আবু উমামা রা. বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি ঈদের রাতে ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের নিয়তে জাগ্রত থেকে ইবাদত করে, তার অন্তর কিয়ামতের বিভীষিকা হতে মুক্ত থাকবে’।
মুয়াজ বিন জাবাল রা. বর্ণনা করেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি পাঁচটি রজনী জাগ্রত থেকে ইবাদত করে, তার জন্য বেহেশত ওয়াজিব হয়ে যায়। রজনীগুলো এই- জিলহজ মাসের অষ্টম, নবম ও দশম তারিখের রাত, ঈদুল ফিতরের রাত এবং শবে বরাতের রাত।
এতেই অনুধাবন করা যায় ঈদুল ফিতরের মাহাত্ম্য, গুরুত্ব ও তাৎপর্য।
ঈদুল ফিতরের শিক্ষা
ইসলামে প্রত্যেক অনুষ্ঠান পালন যথাযথ ও অত্যাবশ্যকীয়, যার মধ্যে নিহিত রয়েছে সুদূরপ্রসারী শিক্ষণীয় দিক। এ হিসেবে ঈদুল ফিতরে যেমন আছে আনন্দ, উল্লাস-উৎফুল্লতা ও ইবাদত, তেমনি আছে সুসংঘবদ্ধতা এবং ঐক্যের এক মহান শিক্ষা। ঈদ আমাদের রুচিশীল ও মননশীল সংস্কৃতির শিক্ষা দেয়। ঈদ উৎসব সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতা শেখায়। চাঁদ দেখে রোজা শুরু করা ও শেষ করার মধ্য দিয়ে যেমন সময়ানুবির্ততা শেখায়, তেমনি ইফতার, সাহরি ঈদগাহের সালাত আদায়ের মধ্য দিয়েও সময়ানুবর্তিতার শিক্ষা পাওয়া যায়। এভাবে মুসলমানদের জীবনে ঈদুল ফিতর এক উজ্জ্বল ও সুন্দর শৃঙ্খলা বোধের সম্মিলনঘটায়। মূলত রমজান এক মাসের একটি প্রশিক্ষণ কোর্স। এ কোর্সের প্রশিক্ষক স্বয়ং আল্লাহ এবং শিক্ষার্থী হলো মুসলিম উম্মাহ। এর সিলেবাস রমজানের রোজা পালনের কালা-কানুন এবং উত্তরপত্র হচ্ছে তাকওয়া অর্জন। আর এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল হচ্ছে বাস্তব জীবনের প্রত্যেক ধাপে ধাপে প্রতিটি পদে পদে তাকওয়ার সুচিন্তিত শিক্ষা। এটি মুসলিম জাতির মাঝে ঐক্য, শক্তি, শান্তি ও প্রগতি তথা ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হবার মাধ্যমে বৈষয়িকতা ও আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা পাওয়া যায়। ঈদগাহে যাবার পূর্বেই জাকাত ও ফিতরা আদায়ের মাধ্যমে ধনীর পক্ষ থেকে গরিবের প্রতি সহানুভূতির যে বিরল ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মিলে ঈদুল ফিতরে। সকল মানুষ সাম্যের অধিকারী- এ স্লোগানের উপাদান বিদ্যমান রয়েছে ঈদুল ফিতরে। তাই তো জাতীয় কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই-
ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই, সুখ-দুঃখ সম ভাগ করে নেব সকলে ভাই, নেই কোনো অধিকার সঞ্চয়ের, বিলাবো মোরা খানাপিনা সকলের। ঈদুল ফিতর আনিছে তাই নববিধান ওগো সঞ্চয়ী উদ্বৃত্ত যা করিবে দান, ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার।। ঈদের দিনে গোসল, নতুন পোশাক পরিধান, সুগন্ধি ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও উন্নত মন-মানসিকতার শিক্ষা অর্জিত হয়। আসলে ঈদুল ফিতরের আনন্দ কাদের জন্য। আমরা কি আদৌ ঈদের গুরুত্ব তাৎপর্য ও শিক্ষা বাস্তবজীবনে প্রতিফলন করতে পেরেছি? এ সম্পর্কে ‘মুজাহেরে হক’ গ্রন্থের একটা আরবি শের-এর তরজমা এখানে প্রণিধানযোগ্য। শেরটি এই-অর্থাৎ ১. ‘‘যে ব্যক্তি নতুন পোশাক পরিধান করেছে তার জন্য ঈদ নয়, ঈদ সে ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহর শাস্তি হতে নিরাপদ থাকে। ২. যে ব্যক্তি ঈদের সাথে সুগন্ধি ব্যবহার করে তার জন্য ঈদ নয়, ঈদ সেই তাওবাকারী ব্যক্তির জন্য, যে পুনরায় পাপাচারে লিপ্ত না হয়। ৩. দুনিয়ার সাজসজ্জায় যে ব্যক্তি সজ্জিত হয় ঈদ সেই ব্যক্তির জন্য নয়, ঈদ সেই ব্যক্তির জন্য যে, আখিরাতের সম্বল তাকওয়া সঞ্চয় করেছে। ৪. সোয়ারীদের ওপর আরোহণকারীর জন্য ঈদ নয়, ঈদ সেই ব্যক্তির জন্য যে পাপাচার ত্যাগ করেছে। ৫. যার জন্য বিছানা পাতানো হয়েছে, তার জন্য ঈদ নয়, ঈদ সেই ব্যক্তির জন্য যে পুলসিরাত অতিক্রম করেছে। তাই তো রাসূলে মকবুল সা. বলেছেন, ঈদুল ফিতরের দিনের নাম হলো ‘ইয়াওমুল জায়িযাহ’ বা প্রতিদান দিবস। এ প্রতিদান দিবসে ঐক্য, শান্তি, প্রগতি, তাহাজিব-তমাদ্দুনকে অটুট ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অনুষ্ঠান মালায় অপসংস্কৃতি পরিহার করে রুচি শীল ও তাকওয়া পূর্ণ সংস্কৃতি বিকাশ ঘটালে আমাদের জীবনে আসবে অনাবিল শান্তি, আনন্দ বিশ্বাস, ভ্রাতৃত্ব ও শিসাঢালা ইস্পাতকঠিন ঐক্য। তাকওয়ায় ভরপুর হোক প্রতিটি মুমিন মুসলিমের আত্মা, এটাই হোক মমো ঈদের প্রেরণা।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …