আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তঘেরা উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা এখন আমের স্¦র্গরাজ্য। চারিদিকে আম আর আম। কাঁচা আমের টক ডাল প্রচন্ড গরম ও রমজানে স্বস্থি দিয়েছে রোজাদারদে মাঝে। শুধু সাতক্ষীরা নয় রনাজধানী ঢাকাতেও এ জেলার কাঁচা আমের সুখ্যাতি ছড়াচ্ছে। রীতিমত মানুষের জীবন যাতায় প্রভাব ফেলেছে সাতক্ষীরার আম। ‘আম অর্থনীতির চাকা বদলে দিয়েছে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে যাচ্ছে এখানকার আম। এবছর আম মৌসুমে বড়ধরণে প্রাকৃতিক দুযোগের কবলে না পড়ায় আম চাষে লাভের মুখ দেখছে চাষিরা। প্রতি বছরই বাড়ছে আম চাষের পরিধি। এবছর ১২ মে থেকে গোপালভোগ, গোবিন্দভোগ বোম্বাই, গোপালখাস, বৈশাখীসহ অন্যান্য স্থানীয় জাত, ২৫ মে হিমসাগর, ১ জুন ল্যাংড়া ও ১৫ জুন থেকে আ¤্রপালি গাছ থেকে আম সংগ্রহ করার নির্দেশনা দেওয়া হয় আমচাষিদের। এদিকে রাসায়নিক দিয়ে পাকানো ফল বাজারজাত করার অভিযোগে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে, এমন কারণ দেখিয়ে সাতক্ষীরায় নষ্ট করা হয় কয়েক হাজার মণ আম। এতে বিপাকে পড়েছে আম সংশিষ্টরা।
দশটি আম উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম এবং আগাম জাতের আম উৎপাদনে সাতক্ষীরা জেলা প্রথম। আম আমাদের দেশে মৌসুমি অর্থকরী ফল হিসেবে গুরুত্ব পেলেও একে শিল্পজাত পণ্য হিসেবে প্রক্রিয়াজাতকরণের কার্যকর গবেষণা অদ্যাবধি না নেয়ায় হুমকীর মুখে পড়তে যাচ্ছে আম চাষ। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার ভারে আক্রান্ত। সাধারণ জনগণের অপুষ্টি দূরীকরণে, বেকারত্ব দূরীকরণ তথা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আম শিল্পের বিকাশ পুরোপুরি ঘটিয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে আমদানি ও রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নার্সারি পর্যায়ে আম চারা উৎপাদন একটি ব্যবসায়, কৃষক পর্যায়ে আম চাষ লাভজনক কৃষি পণ্য, ব্যবসায়ী পর্যায়ে মৌসুমি ব্যবসায় হিসেবে বিবেচিত হলেও আমকে শিল্পের পর্যায়ে ভাবা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে যে পরিমাণ কোমল পানীয়, বিদেশি জুস, জ্যাম, জেলি ইত্যাদি আমদানি করা হয়; আমকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে তা পণ্যে রূপান্তর করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছে,স্তন ক্যান্সার থেকে শুরু করে কোলন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার ও লিউকেমিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে আম বেশ কাজের। উচ্চমাত্রার ভিটামিন সি, ফাইবার ও প্যাকটিন থাকায় রক্তে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ভূমিকা রাখে রসালো আম। ত্বককে ভেতর থেকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে আম। বিশেষ করে ত্বকের ফুসকুড়ি দূর করে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এটি। আমে আছে টারটারিক অ্যাসিড ও ম্যালিক অ্যাসিড। আছে সাইট্রিক অ্যাসিডও। শরীরের অ্যালকালি নামের রাসায়নিকের ভারসাম্য ঠিক রাখে এটি। আমে এতো এতো ভিটামিন আছে যে একটা আম খেলেই কিন্ত শরীরে রোজকার ভিটামিনের চাহিদা মিটে যাওয়ার কথা। আবার এতে ফাইবারও যোগাবে পুষ্টি ও শক্তি। তাই এই মৌসুমে যারা ওজন কমানোর কথা ভাবছেন তারা বার্গার, কোল্ড ড্রিংকস বা সাব-স্যান্ডউইচের বিকল্প খাবার হিসেবে বেছে নিন আম। আমের ভিটামিন এ আমাদের রাতকানা থেকে বাঁচাবে। আমে থাকা এনজাইমগুলো প্রোটিন উপাদানগুলোকে সহজে ভেঙে ফেলতে পারে। এতে খাবার হজম হয় দ্রুত, বাঁচা যায় পাকস্থলী সংক্রান্ত অনেক রোগ থেকেও। এই গরমের হিট স্ট্রোক সাধারণ ঘটনা। আম মানুষের ভেতরটা শীতল রাখে ও শরীরকে অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়া থেকে শরীরের ভেতরের অঙ্গগুলোকে বাঁচায়। এক কাপ আমে আছে ১০০ ক্যালোরি। আর এর ৯০ ভাগই আসে আমে থাকা চিনি থেকে।
এদিকে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের আশায় অপরিপক্ব আম পেড়ে রাসায়নিক দিয়ে পাকিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাচ্ছেন। এরই মধ্যে অভিযান চালিয়ে এমন ৮ হাজার কেজি আম জব্দ করেন র্যাব-৬ সাতক্ষীরা ক্যাম্পের সদস্যরা। পরে বুলডোজার দিয়ে পিষে জব্দকৃত আম নষ্ট করা হয়।
সংশিষ্টরা বলছে, ক্যালসিয়াম কার্বাইড এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ। এটি এক ধরণের যৌগ যা বাতাসে বা জলীয় সংস্পর্শে এলেই উৎপন্ন করে এসিটিলিন গ্যাস। যা ফলে প্রয়োগ করলে এসিটিলিন ইথানল নামক বিষাক্ত পদার্থে রূপান্তরিত হয়। কেমিক্যাল মিশ্রিত ফল খেলে মানুষ দীর্ঘমেয়াদি নানা রকম রোগে বিশেষ করে বদহজম, পেটেরপীড়া, পাতলা পায়খানা, জন্ডিস, গ্যাস্ট্রিক, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়াসহ ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। এছাড়া মহিলারা এর প্রভাবে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিতে পারে। শিশুরা বিষাক্ত পদার্থের বিষক্রিয়ার ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এদিকে ইথোফেন অথবা কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম নিরাপদ বলে দাবি করেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। দেশের মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে গঠিত প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. মাহফুজুল হক বলেছেন, ‘আমরা দায়িত্ব নিয়ে বলছি, ইথোফেন-কার্বাইড দিয়ে আম পাকানো ক্ষতিকর নয়।’ অপরিপক্ব আম রাসায়নিক দিয়ে পাকানোর অভিযোগে ধ্বংস করার সমালোচনা করে তিনি বলেন, অপরিপক্ব আম পাকানো হলে তাতে পুষ্টির মাত্রা কম হতে পারে। কিন্তু সে আম ক্ষতিকর নয়। তাই দেশের সম্পদ ধ্বংস করা ঠিক নয়। ধ্বংসের আগে তা পরীক্ষা করা দরকার। আমচাষিরা বলছেন, এভাবে আম নষ্ট করলে আগামিতে তারা আম চাষ থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) পরিচালক (পুষ্টি) মো. মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ইথোফেন-কার্বাইড তাৎক্ষণিকভাবে মাপা যায় না। তাহলে কীভাবে বুঝে ফলগুলো ধ্বংস করা হলো। তিনি বলেন, আমে ইথোফেন প্রয়োগ করা হলে সেটা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নির্ধারিত মাত্রার নিচে চলে আসে। তিনি বলেন, ‘আমাদের মুখপাত্রদের জ্ঞান এ বিষয়ে দুঃখজনক। ফরমালিন কোনোভাবেই ফল ও শাক-সবজিতে কাজ করে না। এটি কাজ করে আমিষের ক্ষেত্রে।’
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন বলেছেন,কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহযোগিতায় সফল প্রল্পের মাধ্যমে সাতক্ষীরা অঞ্চল থেকে নিরাপদ স্বাস্থ্যসম্মত আমসহ অন্যান্য সবজি রফতানি হচ্ছে। আশা করছি এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।