সারা দেশ তীব্র তাপদাহে পুড়ছে। সর্বত্রই অসহনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গরমে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ডায়রিয়া, কলেরাসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শত শত মানুষ প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। প্রচ- গরমে মিলছে হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর খবর। বেশি অসুস্থ হচ্ছেন বয়স্ক ও শিশুরা। মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) বা কলেরা হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছে পাঁচ শতাধিক রোগী।
আইসিডিডিআর,বি সূত্র জানায়, সাধারণ সময়ে গড়ে সাড়ে তিনশ’ রোগী ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালটিতে আসেন। অথচ গত এক সপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছেন পাঁচ শতাধিক রোগী। যার অধিকাংশই শিশু। আইসিডিডিআর,বি’র পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ১০ই এপ্রিল ৫৩৪ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হন।
বিজ্ঞাপন
এরপর ১১ই এপ্রিল ৪৮৪ জন, ১২ই এপ্রিল ৪৯১ জন, ১৩ই এপ্রিল ৫১৫ জন, ১৪ই এপ্রিল ৫৩০ জন, ১৫ই এপ্রিল ৫৬৫ জন, ১৬ই এপ্রিল ৫২২ জন, ১৭ই এপ্রিল ৫৩৪ জন, ১৮ই এপ্রিল চিকিৎসা নিয়েছেন ৪৯৫ জন এবং ১৯শে এপ্রিল দুপুর ১টা পর্যন্ত ২৪৯ জন রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে বেশির ভাগ রোগীকে দুই-তিন ঘণ্টার জন্য ভর্তি রেখে রিলিজ দেয়া হয়। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ভিড় তেমন একটি নেই বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।
আইসিডিডিআর,বি’র মিডিয়া ম্যানেজার একেএম তারিফুল ইসলাম খান বলেন, গরমে সাধারণ সময়ের তুলনায় ডায়রিয়া আক্রান্তের হার কিছুটা বেড়েছে। তবে এই সময়ে ডায়রিয়া রোগীদের আরও অনেক বেশি চাপ থাকে। বছরে দুই সময়-যেমন বর্ষার শুরু ও শীতের আগের সময়টাতে ডায়রিয়া রোগীর চাপ বাড়ে। এই সময়েও চাপ থাকে। তবে এবার রোজা থাকায় মানুষ বাইরের খাবার কম খাচ্ছে। আদ্রতা কম হওয়ার কারণে মানুষ ঘামাচ্ছে কম। কলেরার টিকা দেয়া হয়েছে গত বছর। এছাড়াও যারা কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পরের তিন বছর ফের কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে তাদের। এসব মিলিয়ে আশা করছি এবার রোগীর চাপ আগের তুলনায় কম থাকবে।
হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক গণমাধ্যমকে জানান, কলেরা ছাড়াও ডায়রিয়া অনেক কারণেই হয়। বর্তমানে গরম একটা কারণ ডায়রিয়া বাড়ার। তবে এই ডায়রিয়ায় তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াই রোগী সুস্থ হয়ে যায়। এখন খুব খারাপ অবস্থা নিয়ে রোগী আসছে না। সর্বোচ্চ দু’-একজন ঢাকার বাইরের এলাকা থেকে জটিলতা নিয়ে আসেন। আইসিডিডিআর,বি’র জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. ইকবাল হোসেন বলেন, গত কয়েকদিনে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় রোগী কিছুটা বেড়েছে। কারণ, গরম এলে সব বয়সীরাই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। গরমের কারণে সবাই পিপাসার্ত থাকেন। তাই গরমে তৃষ্ণা মেটাতে অনেকেই অনিরাপদ পানি পান ও অস্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছেন। এতে ফুড পয়জনিং থেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া ভালোভাবে হাত ধোয়া ও অন্য স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। অনেকে রাস্তার পাশের দোকান বা ফুটপাথ থেকে অনিরাপদ পানি ও শরবত পান করছেন। আমাদের প্রয়োজন সুপেয় পানি। সেই পানি আমরা অনেক সময় পাই না। ফলে ডায়রিয়ার প্রকোপ কিছুটা বেড়েছে। তিনি বলেন, এ সময়ে হিটস্ট্রোকের আশঙ্কাও বেশি থাকে। আমাদের সবার বাসায় ফ্রিজ নেই। খাবার তৈরির পর সেটি আমরা বেশ কিছুক্ষণ বাইরে রাখি। কিন্তু এই গরমে শীতের মতো খাবার অধিক সময় ভালো থাকে না। যে কারণে খাবারে অল্প পরিমাণ জীবাণু থাকলেও সেটি গরমে অনেকটা মাল্টিপ্লাই (সংখ্যা বৃদ্ধি) হয়। তাদের (জীবাণু) শরীর থেকে রস বের হয়। এ কারণে অল্প পরিমাণ খাবার খেলেও আমাদের ডায়রিয়া হয়।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, সারা দেশে গত কয়েকদিন ধরে যে মাত্রার তীব্র গরম পড়ছে, তাতে যে কেউ যে কোনো সমস্যায় অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। এক্ষেত্রে কৃষক, রিক্সা চালকসহ যাদের রোদে পুড়ে ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের কাজ করতে হয়, তাদের গরমজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি ডায়াবেটিস ও কিডনি বিকলসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, বয়স্ক ও শিশুরাও ঝুঁকিতে রয়েছেন। তিনি বলেন, তীব্র গরমে ড্রিহাইড্রেশন অর্থাৎ, শরীরে পানিশূন্যতা বা স্বল্পতা দেখা দিচ্ছে। অনেকের রক্তচাপ ও প্রস্রাব কমে যেতে পারে। গরমে শরীরে তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রির ওপরে উঠলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া ও পাল্স (নাড়ির স্পন্দন) কমে যেতে পারে। এ সময়ে ঘরের বাইরে যতটা কম যাওয়া যায়, ততই ভালো। যারা প্রয়োজনে বাইরে যাচ্ছেন তারা পানির সঙ্গে একটু লবণ মিশিয়ে স্যালাইনের মতো প্রস্তুত করে খেতে পারেন। এতে ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে বের হওয়া লবণের ঘাটতি পূরণ হবে। সবাইকে ঢিলেঢালা সূতি কাপড় পরতে হবে। গরমের সময়ে শিশুদের ঘরের বাইরে না যাওয়া, টিলেঢালা আরামদায়ক পোশাক ব্যবহার করা, নিয়মিত গোসল করানো, ফ্রিজের ঠা-া পানি ও বরফ খাওয়া থেকে বিরত রাখার পরামর্শ দেন তিনি।