কেমন হচ্ছে এবারের ঈদ উদযাপন

ঈদুল ফিতর মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা এ উৎসব পালন করেন। রোজা ও ঈদের যেমন ধর্মীয় ভাবমর্যাদা আছে, তেমনই আছে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য। ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা থেকে ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা আরবি রমজান মাসব্যাপী সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার না করে সংযম সাধনা করেন। এ সাধনার মধ্য দিয়ে তারা অর্জন করেন একদিকে নিজের জন্য আত্মশুদ্ধি এবং অন্যদিকে অনুধাবন করেন দরিদ্র মানুষের অনাহারের দুঃখ-কষ্ট। আশা করা হয়, একজন মুসলমান এক মাস রোজা রেখে যে সংযম ও আত্মত্যাগের প্রশিক্ষণ পাবেন, বাকি এগারো মাস সে অনুযায়ী জীবন নির্বাহ করবেন।

সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়, সমাজে ধার্মিকতা যত বাড়ে, অন্যায়, জুলুম, দুর্নীতি ও অপরাধপ্রবণতা তত কমে। তবে বাংলাদেশি সমাজে এ ব্যাপারটি প্রযোজ্য নয়। এ সমাজে একদিকে মানুষের মধ্যে যেমন ধর্মচর্চা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে দুর্নীতি, মুনাফাখোরি, খুন, পরশ্রীকাতরতা ও অপরাধপ্রবণতা। একদিকে রাজধানীতে জুমার নামাজে মসজিদে যেতে একটু দেরি হলে জায়গা না পেয়ে যেমন রাস্তায় নামাজ পড়তে হয়, অন্যদিকে আবার মসজিদ থেকে হয় জুতা চুরি। আবার অফিস-আদালতে অবৈধ লেনদেন না করে রোজাদার কর্মচারীদের কাছ থেকে নিজের কাজের ফাইল ছাড়িয়ে আনা যায় না। এ সমাজে সারা জীবন ঘুস খেয়ে অবসরে গিয়ে হজ করে এসে লম্বা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে হাজি সাহেব ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে অনুদান প্রদান (সামাজিক ঘুস) করে সামাজিক সম্মান ক্রয় করতে পারেন। ধার্মিকতার নামে এ কেমন হঠকারিতা?

ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী সারা বিশ্বের মুসলমানদের মতো বাংলাদেশেও মুসলমানরা এক মাস রোজা পালনের পর ঈদের দিন ঈদগাহে গিয়ে জামাতের সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেন। ঈদকে খুশির উৎসব হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কবি নজরুলের বহুল প্রচারিত গানেও ঈদকে খুশির উৎসব বলা হয়েছে। ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ।’ উল্লেখ্য, অন্যান্য বছরে পালিত ঈদের চেয়ে এবারের ঈদ উৎসব ভিন্নভাবে উদ্যাপিত হবে। কারণ, এ বছর হলো নির্বাচনের বছর। ঈদের পরপর অনুষ্ঠিত হবে কয়েকটি বড় সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। কিন্তু তার চেয়ে বড় খবর হলো, এ বছরই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর। যেহেতু পরপর কয়েকটি সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, সে কারণে মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দেশে অনেকদিন থেকেই রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে দাবি উঠেছে। ছলচাতুরির, রাতের ভোটের বা প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনী ব্যবহার করে নির্বাচন জিতে নেওয়ার বিরুদ্ধে এবার রাজনৈতিক দলগুলো এবং সচেতন জনগোষ্ঠী যথেষ্ট সোচ্চার। এরা দলীয় সরকারের পরিবর্তে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। এমন দাবি পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর অনেকেই সমর্থন দিচ্ছে। এমনই এক পরিবেশে এবার ঈদ উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে। এ ঈদ কার কেমন কাটবে, তা অনুমান করা কঠিন নয়।

দুর্নীতিবাজ, মুনাফাখোর, মজুতদার এবং বড় বড় মেগা প্রজেক্টের কন্ট্রাক্টরদের ঈদ গতানুগতিকভাবে আগের মতো এবারও ভালো কাটবে। ইতোমধ্যে তাদের অনেকেই গরিব-দুঃখীদের মধ্যে ক্যামেরাপারসন সঙ্গে নিয়ে ইফতারসামগ্রী বিতরণ করেছেন। এদের বেশির ভাগই ঈদ শপিংয়ে সিঙ্গাপুরে, ভারতে। এদের হাতে ব্যাপক টাকা। কাজেই এদের ছেলেমেয়েদের কেনাকাটায় কোনো বাধা নেই। তবে দেশের সাধারণ চাকরিজীবী, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ঈদ ভালো কাটবে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এরা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এদের পরিবারে ইফতারের টেবিলে খাবার তালিকা ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসছে। ঈদ এদের অনেকের জন্যই বোঝা। ছেলেমেয়ে ও পারিবারিক সদস্যদের সবাইকে এরা ভালো জামা-কাপড় কিনে দিতে পারছেন না। কাজেই এমন পরিবারপ্রধানের কাছে ঈদ এক দুর্ভাবনা হয়ে হাজির হয়েছে।

গরিব-দুঃখীদের সহায়তা পাওয়ার দিক থেকে ২০২৩ সালের ঈদটি মন্দ যাবে না। কারণ, ঈদের পরপরই ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এসব নির্বাচনে যারা মেয়র এবং কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তারা ইতোমধ্যে প্রচারণার অংশ হিসাবে পোস্টার ছেপেছেন। নিজ নিজ এলাকার মসজিদে জুমার নামাজের পর অনেক প্রার্থী নিজের পক্ষে ভোট চেয়ে লিফলেট বিতরণ করছেন। দরিদ্র এলাকার লোকজনের খোঁজখবর নিচ্ছেন। কাজেই এবারের ভোটকে সামনে রেখে অনেক ভোটপ্রার্থী গরিবদের মধ্যে সাহায্যসামগ্রী বিতরণ করবেন। বস্তিবাসীদের ভাগ্য ভালো হলে একাধিক প্রার্থীর কাছ থেকে আর্থিক বা খাদ্যসামগ্রী হিসাবে ঈদ উপহার পেতে পারেন তারা। সেদিক দিয়ে শহর এলাকার দুস্থ ভোটারদের ঈদ উদযাপন গতবারের চেয়ে ভালো হবে বলে মনে করা যায়।

আবার এ বছরই হওয়ার কথা জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেদিক দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীরাও নিজ নিজ এলাকায় ঈদ উদযাপন করবেন। এলাকায় এলাকায় গিয়ে ভোটারদের খোঁজখবর করবেন। গরিবদের সহায়তা দেবেন। তবে ক্ষমতাসীনদলীয় নেতাকর্মীদের ঈদ বাহ্যিকভাবে ভালো কাটলেও তারা দুর্ভাবনার মধ্যে ঈদ উদযাপন করবেন। কারণ, তারা জানেন, গত দুটি নির্বাচনের মতো এবারের নির্বাচনটিও যদি প্রশাসনযন্ত্র ও পোশাকধারী বাহিনী ব্যবহার করে নিজেদের পক্ষে ম্যানিপুলেট না করা যায়, তাহলে দুর্ভাবনার কারণ আছে। কারণ, আর্থিক লুটপাট বন্ধ করতে না পারা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, বেকার সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা, জাতীয় সংসদ, নির্বাচনব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে না পারায় দেশের মানুষের মধ্যে সরকারের ওপর অসন্তোষ বেড়েছে। এমতাবস্থায়, নির্দলীয় সরকারের অধীনে মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন হলে তাদের দলকে জনগণ কতটা সমর্থন দেবেন সে সম্পর্কে তাদের ধারণা আছে। এজন্য সরকারদলীয় মন্ত্রী, এমপি এবং নেতাকর্মীদের ঈদের সময়টা দুর্ভাবনায় কাটবে। রাতে তাদের ভালো ঘুম হবে না। এদের অনেকেই ক্ষমতা হারানোর দুঃস্বপ্ন দেখবেন। কারণ, এরা জানেন, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। আর পরাশক্তিধর বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো যেভাবে মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের জন্য ক্রমান্বয়ে চাপ বৃদ্ধি করছে, তাতে করে সরকারকে হয়তো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার স্বার্থে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পরিবর্তে অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থায় নির্বাচন করতে হবে। আর এমন নির্বাচন হলে তারা যে সে নির্বাচনে ভালো করতে পারবেন না, তা তারা বুঝতে পারছেন। ফলে বিরাজিত পরিস্থিতিতে তাদের ঈদ হবে মহাদুর্ভাবনার ঈদ।

রাজধানীতে পর্যায়ক্রমে একটির পর একটি মার্কেটে, বায়তুল মোকাররম মার্কেটের সোনার দোকানে এবং অন্যান্য স্থাপনায় ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডকে অনেক সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক অগ্নিকাণ্ড মনে করছেন না। তাদের অনেকে একে রাজনীতির অপকৌশলের অংশ বিবেচনা করছেন। এসব অগ্নিকাণ্ডে হাজার হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের জীবন ও জীবিকা তছনছ হয়ে গেছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও তাদের পারিবারিক সদস্যদের ঈদ হবে কষ্টের। এবারের ঈদের ছুটিতে আরও অগ্নিকাণ্ড ঘটবে কিনা, তা এখনই বলা যাবে না। তবে যতই আগুন লাগুক, এ আগুনের উত্তাপ জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ হিসাবে মুক্ত ও অবাধ সংসদ নির্বাচনের দাবি নিষ্প্রভ করতে পারবে না।

আবার বিএনপিসহ অন্যসব বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ঈদ হবে তুলনামূলকভাবে ভালো। অনেকটা স্বপ্ন জাগানিয়া। যদিও তাদের অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, অনেকে রয়েছেন কারাগারে, তারপরও তারা নতুন পরিবর্তনের আশা করছেন। তারা লক্ষ করছেন, তাদের অহিংস আন্দোলন, বড় বড় শহরকেন্দ্রিক সমাবেশ, পদযাত্রা, ইত্যাদিতে সরকারি বাধাবিপত্তি থাকা সত্ত্বেও ব্যাপক মানুষ অংশগ্রহণ করেছেন। তারা যে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবির জন্য লড়ছেন, তাতে সাধারণ মানুষ সমর্থন দিচ্ছেন। এছাড়াও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা যখন দেখছেন, বৃহৎ পরাশক্তিধর আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশ তাদের দাবি সমর্থন করে কথা বলছেন, বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন, তখন তারা ক্ষমতা রদবদলের স্বপ্ন দেখছেন। আর মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব হলে সরকারি দল যে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না, সে বিষয়ে তারা অনেকটাই নিশ্চিত। এ কারণে তাদের ঈদ কাটবে নতুন স্বপ্ন ও সম্ভাবনা ধারণ করে। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা নিজ নিজ এলাকায় ঈদ করতে গিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নির্দলীয় সরকারাধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অহিংস আন্দোলনে শামিল হতে উদ্বুদ্ধ করবেন।

এবারের ঈদের পর অনুধাবন করা যাবে সরকার সংবিধানের কথা বলে দলীয় সরকারের অধীনে তথাকথিত নির্বাচনের সিদ্ধান্তে অটল থাকবে, নাকি গণদাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ভিন্ন কোনো ব্যবস্থাধীনে সংসদ নির্বাচন করবে। ইতোমধ্যে ঈদের আগে রমজান মাসেই ইভিএম নিয়ে যে বিতর্ক চলমান ছিল, তার অবসান ঘটেছে। নির্বাচন কমিশন দেরি করে হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে কাগজের ব্যালটে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত যেমন ভালো হয়েছে, তেমনি এ বিতর্কিত ও পুরোনো ইভিএম দিয়ে সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্তটি গ্রহণযোগ্য নয়। এসব স্থানীয় সরকার নির্বাচনও পুনর্বিবেচনা করে কাগজের ব্যালটে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত ইসির। এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো সংসদ নির্বাচনের আগে কাগজের ব্যালটে করলে তা ইসির জন্য ব্যালটে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি অগ্রিম রিহার্সেল হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। শান্তি ও গণতন্ত্রপ্রিয় নাগরিক হিসাবে আমরা আশা করব, ঈদের পর যত দ্রুত সম্ভব সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচন মুক্ত ও অবাধ করার ব্যাপারে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছতে পারবে।

 

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক (এলপিআর), রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।